আসলে একা ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও, একা trekking এর সাহস হচ্ছিলো না. ঠিক যেমন চাওয়া, ঠিক তেমন তিনজন বন্ধুর প্রাপ্তিযোগ হলো. তারা আমার বন্ধু আগে থেকে ছিলো বটে, তবু বুঝিনি যে আমাদের ইচ্ছেরাও একে ওপরের বন্ধু. ব্যাস, তারপর আর কি চাই…
তাও ছোট করে বলে দিই – rucksack, jacket, trekking pole, shoe, প্রচুর পরিমাণে dry foods. এছাড়াও আরও কত্ত কি !!
ট্রেন ছিল ঠিক একটা নাগাদ হাওড়া থেকে, কিন্তু শুরুতেই বিভ্রাট. দুঘন্টা মতো দেরিতে এলো. তাতে কী? সেসব কিছুই আমাদের আনন্দ মাটি করার জন্য যথেষ্ট ছিল না. শুরু হলো যাত্রা. সবই যেন খুব ভালো হচ্ছিলো আমাদের সাথে, যেমন আমাদের সহযাত্রী. কয়েকটা দল, সবরকম বয়সের মানুষজন. আমাদের সাথে ছিলেন তিনজন কাকু. সে কি গল্প আমাদের, কয়েক ঘন্টাতেই আলাপ এতই জমলো যে যাই খাওয়াদাওয়া হয় সবই ভাগ বাটোয়ারা হতে শুরু করলো. তাঁদের আরও অনেক অভিজ্ঞতার কোথাও জানা হলো. এইভাবে গল্পগুজবে সময় কেটে গেলো, আর আমরা পৌঁছে গেলাম হরিদ্বারে পরের দিন সন্ধ্যেবেলা.
হরিদ্বার স্টেশন পৌঁছতে 6টা বেজে গেলো. ওখানেই আমাদের retiring room বুক করা ছিল. তাই চটপট মালপত্র রেখেই দৌঁড় দিলাম ঘাটের দিকে, গঙ্গা আরতি দেখবো সেই আশায়. কিন্তু এক যাত্রায় সব পাবো সেটা আশা করাও যে বাড়াবাড়ি সেটা বুঝলাম ঘাটে পৌঁছনোর পর. কিছুক্ষণ দেরীর জন্য দেখতে পারলাম না আরতি. কিন্তু যা দেখলাম, তাতেই আমাদের মুগ্ধতা আকাশ ছুঁলো.
এরকম গঙ্গার রূপ আমরা আগে দেখিনি, এই স্রোত কলকাতায় কই !! সেই স্রোতের তুমুল আওয়াজ আর ভালো লাগা নিয়ে আমরা ফিরে এলাম. ঘাটে যাওয়ার আগে বাসের টিকিট বুক করতে গিয়েই দেরীটা হয়েছিলো, কিন্তু সেটা না করলে যে পরের দিন আর গোবিন্দঘাট যাওয়া হতো না আমাদের. দাদা বৌদির হোটেলে গরম গরম বাঙালি খাবার খেয়ে জলদি ঘুম দিলাম, পরের দিন ভোর 5 টায় বাস ধরবো তাই.
Day 3: 5th August
ভোরবেলা চটপট ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম. শুরু হলো বারো ঘন্টার বাস যাত্রা. একের পর এক মনোরম সব দৃশ্যের সাক্ষী হতে হতে এগিয়ে চললাম আমরা. কখনো বিশালাকার পাহাড়, কখনো ধীর স্থির গতিতে বয়ে চলা নদী. সন্ধ্যের মধ্যে পৌঁছে গেলাম গোবিন্দঘাট.
চারজনের জন্য একটি রুম নেওয়া হলো. সেখানেও প্রাপ্তি ঘটলো, ঘরের একদম সামনেই ছবির মতো ঝর্ণার দৃশ্য. ব্যাগ রেখে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম গোবিন্দঘাট গুরুদ্বারের পথে. বর্ষাকাল, বৃষ্টি ভিজেই trek করে এখানে. মার্কেট থেকে পঞ্চ কেনা হলো বৃষ্টির হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়ার আশায়. গুরুদ্বারে রাতের খাবার খেয়ে ফেরার জন্য রওনা দিলাম কারণ পরদিন ভোরে আমাদের সেই শখের যাত্রা শুরু. ফেরার সময় বৃষ্টি শুরু হলো, কাজে লেগে গেলো সদ্য কেনা পঞ্চটি. রুমে ফিরে আবার সব গুছিয়ে, পরিমাণ মতো গ্লুকোন ডি বানিয়ে ঘুম দিলাম.
ভোরবেলা গুরুদ্বারা অব্দি হেঁটে গিয়ে ওখান থেকে গাড়িতে 4 কিমি যাওয়ার কথা. কিন্তু বেরোতেই দেখলাম মুষলধারে বৃষ্টি, হেঁটে যাওয়া কল্পনার বাইরে. ঠিক তখনই দেবদূতের মতো হাজির হলো এক দল ছেলে যারা ঐ হোটেলেই রুম নেবে বলে দর কষাকষি করছে, গাড়ি ছিল ওদের কাছে. কোনো উপায় না পেয়ে ওদেরই বললাম গুরুদ্বারা অব্দি পৌঁছে দিতে. ভালো মানুষ ওরা, রাজি হয়ে গেলো.
গুরুদ্বারা পৌঁছে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়িতে করে পুলনা গেলাম. গিয়েই পোর্টার নিলাম ব্যাগপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য. প্রথম ট্রেকেই ওস্তাদি করলাম না আর. নিজের পৌঁছনোটাই অনেক বড়ো ব্যাপার মনে হলো তখন. ম্যাগি খেয়ে হাঁটা শুরু করলাম দশটার দিকে. এবার গন্তব্য ghangharia, হাঁটতে হবে 10 কিমি, তবে altitude 5500 feet থেকে হয়ে যাবে 10200 feet.
শুরুতে নতুন ব্যাপার তাই মজাই লাগছিলো, ধীরে ধীরে বুঝছিলাম এই ট্রেক ব্যাপারটা কতটা নতুন আর আলাদা. কষ্ট হয়নি, সেটা বলা মিথ্যে হবে. কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা, এতরকম অভিজ্ঞতা জীবনে সত্যি প্রথমবার. কত রাজ্যের, কত ভাষার, কত বয়েসের, কত রকম মানুষের সাথে আলাপ, তাঁদের কতরকম অভিজ্ঞতা – এটাই ছিলো অন্যতম প্রাপ্তি আমাদের.
আমি বাকি তিনজনের থেকে তুলনামূলকভাবে জোরে হাঁটি তাই বেশিরভাগ সময় আমি একাই ট্রেক করছিলাম. এটা trekking এর নিয়মে উচিত না অনুচিত জানি না, কিন্তু প্রথমবার তাই নিজের দমের উপর ও অন্ধ ভরসা করা ঠিক মনে হয়নি. জোর কদমে হেঁটে বারোটা নাগাদ আমি মাঝের একটি ব্রিজের কাছে চলে এসে বাকি বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি. তখনো 4 কিমি মতো বাকি, খোঁজ নিয়ে জানলাম ঐ বাকি পথটা আরও বেশি কঠিন. তাতে কী? চলতে তো আমাদের হবেই.
তাই সামান্য পেটপুজো করে রওনা হলাম. হালকা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, o2 আর Co2 র যুদ্ধে শামিল হতে হতে অবশেষে পৌঁছলাম ghangaria বেলা 3 টে নাগাদ. আমাদের পোর্টার দাদাটি বেজায় ভালো লোক ছিলেন, উনিই তাঁর পরিচিত এক হোটেলে রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন. এবারও একই রুমে 4 জন. এক এক করে সবাই পৌঁছোলাম. আবার সব গুছিয়ে, স্নান করে আমরা বেরোলাম আশেপাশের ময়নাতদন্ত করতে. আগেই বলে রাখি, ওখানে bsnl বাদে নেটওয়ার্ক পাওয়া অসম্ভব. প্রতি মিনিট 10 টাকায় ফোন করার উপায় আছে. বেশি এদিক ওদিক না করে, আমরা চলে গেলাম এখানকার গুরুদ্বারাতে. ওখানেই সেরে নিলাম রাতের ভোজন. তারপর ঘরে ফিরে ক্লান্তিতে চিৎপটাং. 4দিন হাঁটা, তাই প্রত্যেকদিনই glucon D জরুরী, ওটা তাই নিয়ম মেনে আগের দিন 4 বোতল করে বানিয়ে রাখতাম.
Day 5: 7th August
আজকা নাম valley of flowers কে নাম. ভোর 6.30 টায় আরম্ভ করলাম. শুরুতেই মুগ্ধ করে দিলো ঐ ছোট্ট গ্রামটি. আগের দিন সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো বলে বুঝতেই পারিনি এর সৌন্দর্যের ব্যাপ্তি কিছু কম না. টিকিট কেটে চলা শুরু হলো আমাদের. কিছুটা যেতেই নজর কাড়লো সে এক বিশাল ঝর্ণা. যার সামনে দিয়ে সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হবে.
পুরো পথটাই ছিল সরু, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আর স্যাঁতস্যাতে. বেশ কিছুটা চলার পর দ্যাখা মিললো হরেক রকম ফুলের. তবু আমার মূল আকর্ষণ ছিল blue poppy র প্রতি. অনেক খুঁজেও সে অধরাই থেকে যাচ্ছিলো. চলতে চলতে ঝুলন্ত পাথর পেরিয়ে, valley দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে 11.30 টায় পৌঁছোই তৃতীয় ঝর্ণার কাছে. এবার ফেরার পালা কারণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরতে হবে টিকিট কাটার সময়ই বলে দেওয়া হয়েছিলো. ফেরার পথে দ্যাখা হলো আমার বন্ধুদের সাথে. ফিরবো একসাথেই, তাই ধীরে সুস্থে গল্প গুজবে হাঁটতে থাকলাম. ফেরার পথেই খোঁজ মিললো আমার blue poppy র. সাথে দ্যাখতে পেলাম cobra lily আর snake lily ও.
বিকালের মধ্যে নীচে নেমে এলাম. চা আর কিছু হালকা খাবার খেয়ে রুমে ফিরলাম. দুদিন ক্রমাগত হাঁটার পরিণাম বেশ ভালোই টের পাচ্ছিলাম. গা হাত পায়ে অসহ্য যন্ত্রনা, সব মিলিয়ে আমাদের নাজেহাল অবস্থা. বাকি তিন বন্ধু ঠিক করলো ওরা খচ্চর চড়েই যাবে পরের দিন hemkund. কিন্তু আমি হেঁটে যাবার পক্ষে অনড় রইলাম. আবার যে যার মতো খাবার খেয়ে ঘুমকে আঁকড়ে ধরলাম নিমেষে.
আজ কঠিনতম দিন. রাস্তা 7 কিমি হলেও, altitude 14200 feet. পুরোটাই চড়াই রাস্তা, যা আমি অনেকের থেকেই শুনেছিলাম. আগের দিন গুলোতে বৃষ্টি হলেও, এই দিনটা ছিল ঝা চকচকে. বরফ মাখা পাহাড়গুলোর যে কী অপরিসীম আকর্ষণ ক্ষমতা তা না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই. আমি যে একা, তা বোঝবার সুযোগ ছিল না. কত চেনা অচেনা মানুষজনের সাথেই হেঁটে যাচ্ছিলাম অনবরত. সবাই আমরা একে ওপরের সাহায্যে এগিয়ে, সে এক আনকোড়া আনন্দ.
মাঝে দুটো ভয়ঙ্কর short cut নিলাম, সবাই একসাথে ছিলাম বলেই ঘটলো ব্যাপারটা. একজন 55 বছর বয়সী ঘরোয়া মহিলাও যে ঐ short cut দিয়ে যেতে সফল হতে পারে, তা তো না দেখলে হয়তো আজও ভাবতেই পারতাম না. তাই কাউকে দেখে বলা অসম্ভব কে কী করতে পারে !! সবই আসলে ইচ্ছাশক্তি, তার উপরে কিছুই নেই. ঐ রাস্তায় দ্যাখা পাওয়া গেলো একটা বড়ো মাপের glacier এর. ব্রহ্মকমল – এক বিরল প্রজাতির ফুল, যা শুধু ওখানেই মেলে. এক যাত্রায় সব তো আর জোটে না, তাই কাছ থেকে দেখতে পেলাম না. দূর থেকেই দর্শন মিললো.
5 ঘন্টা হাঁটি হাঁটি পা পা করার পর পৌঁছলাম hemkund sahib. রাজকীয় গুরুদ্বার যাকে বলে. গিয়েই গরম গরম খিচুড়ি তার চায়ের উপর হামলে পড়লাম. তারপর কিছুক্ষণ জলাশয়ের সামনে শান্ত মনে বসে উপভোগ করলাম পাহাড়িয়ানা. কিছুটা সময় কাটিয়ে তৈরী হলাম ফিরবো বলে. আবার ও আমার সেই তিনজন বন্ধুদের সাথেই ফিরবো বলে একসাথে পা চালালাম. নামতে গিয়ে হাঁটুর অবস্থা কাহিল, ব্যাথা তো ছিলই, এবার জুড়লো হাঁটু ভাঁজ না করতে পারার চাপ. কোনোরকমে মনের জোরে নেমে এলাম নীচে. পরের দিন আবার সেই 10 কিমি, সেটাও আবার নামতে হবে, যখন কিনা হাঁটুর চাঙ্গা থাকা সব থেকে জরুরি. সত্যি বলতে একবার হলেও ভেবেছিলাম হয়তো পারবো না, খচ্চর নিতে হবে.
কিন্তু ঐ যে বলে যার শেষ ভালো তার সব ভালো, তাই হয়তো আর শেষটা মাটি করতে চাইনি. এইসব দ্বন্দ্ব মাথায় নিয়ে সেদিনের মতো দিন শেষ করলাম বিছানায় এক লাফ দিয়ে.
যেমন ভাবনা, তেমনি কাজ. আবার মালপত্র খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে রওনা হলাম একটু দেরি করেই. এবার ইচ্ছা ছিল গোবিন্দঘাটে না থেকে একেবারে জোশীমঠে চলে যাবার. হরিদ্বারের পথে একটু এগিয়ে থাকা হবে, আবার আর একটা নতুন জায়গাতেও থাকা হবে. বেশ কষ্ট করে হলেও, নেমে এলাম. গোবিন্দঘাট পৌঁছতেই জোশীমঠ যাওয়ার গাড়িও পেয়ে গেলাম. বিকালের মধ্যে ঢুকে গেলাম জোশীমঠ.
এবার অন্তত গুরুদ্বারাতে থাকবো সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম. তাই রুম পেতে অসুবিধা হলো না. খুবই অল্প টাকায় VIP রুমের ব্যবস্থা হয়ে গেলো আর খাওয়াদাওয়া তো টোটালী ফ্রি. ওখানে ফিরে আর একটা বিশাল প্রাপ্তি ঘটলো, সেটা হলো 4 দিন পর ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলো. সবাই আমরা হুড়মুড়িয়ে ফোন করতে শুরু করলাম প্রিয়জনদের আর সাথে ফোটো পোস্ট. আবার বিকালের দিকে বেরিয়ে পরের দিনের বাস বুক করে একটু চড়তে বেরোলাম. কিছু মন্দির আর পাহাড়ি দৃশ্য দেখে ক্লান্ত মনে রুমে ফিরলাম. গুরুদ্বারাতেই খেয়ে নিলাম রাতে. তারপর জন্মের ঘুম দিলাম.
পুরোটাই ট্রেনের ভিতর. খুবই ক্লান্ত, যে যার মতো সময় গুনছে বাড়ি ফেরার.
অবশেষে ঘরের মেয়েরা ঘরে ফিরলো একরকম বিশ্বজয় করেই.