সময়টা ছিল ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ। আমরা জনাকয়েক বন্ধু সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে
প্রয়োজনীয় কিছু জিনিষপত্র ছাড়া ছিল স্থানীয় থানা ও মহকুমা শাসকের অনুমতিপত্র। বেড়ানোর মানচিত্রটা ছিলো খড়্গপুর – বালাসোর – চাঁদিপুর – পঞ্চলিঙ্গেশ্বর – রেমুনার ক্ষীরচোরা গোপীনাথ – তালসারি – দীঘা হয়ে ফিরে আসা। সময়সীমা ১৩ দিন।
খড়্গপুর – বাস্তা – বালাসোর হয়ে চাঁদিপুর পৌঁছলাম দুপুর নাগাদ। আমরা সাইকেল টুরিস্ট হবার সুবাদে, যে যেভাবে পেরেছেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, হয়ত বা একটু বেশীই প্রসারিত করেছেন আমাদের উদ্দেশ্যে। চাঁদিপুরে দু’দিন কাটিয়ে আমরা ওড়িশার আর এক অনিন্দসুন্দর স্থান পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের দিকে সাইকেলে পা রাখলাম।
জঙ্গল, টিলা, পাহাড় নিয়ে সবুজে ঘেরা পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। এক যাত্রায় একসঙ্গে এতগুলো দর্শন করতে গেলে
অবশ্যই যেতে হবে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে। বালাসোর থেকে দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। প্রথম দর্শনেই ভালো লাগলো
নীলগিরি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। চারিদিকে সবুজের হাতছানি আর নিস্তব্ধতা জায়গাটার অন্য এক মাত্রা এনে দিয়েছে। দেবভূমির এক কিলোমিটার আগে ওড়িশা সরকারের পান্থনিবাস। সেই সময় এখানে থাকার জায়গা বলতে একমাত্র ভরসা এই পান্থনিবাস। এখন গেলে হোটেল মিলবে। কপাল ভাল হলে হোম স্টেও পেয়ে যেতে পারেন। শান্ত, নির্জন পরিবেশে গ্রাম্য আদিবাসীদের বাস। সাইকেল রেখে দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে আমরা পায়ে পায়ে চললাম দেবভূমীর দিকে। সিঁড়ি ভেঙে ক্রমশ উপরে উঠতে লাগলাম।
চলার পথে বারবার দেখা পেলাম পাহাড়ী ঝর্ণার। কোথাও তির তির করে বয়ে চলেছে ঝর্ণার জল, আবার কোথাও ঝর্ণা সশব্দে নেমে এসে তার জানান দিচ্ছে। পাহাড়ের উপর থেকে সমতল গ্রাম, ফসলের ক্ষেত, মেঠো পথ ঘাট সবই যেন পটে আঁকা ছবির মতো। প্রায় ২৫০টা সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে আরও খানিকটা পাহাড়ে চড়ার পরে একটু নিচে নেমে ছোট একটা সমতলে পৌঁছনো গেলো।
এখানেই পাহাড়ের গায়ে ছোট একটা জলাধারের গর্তে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের অধিষ্ঠান। এই শৈবতীর্থের একটা অদ্ভূত বৈশিষ্ট আছে। এখানকার দেবতার মূর্তি চোখে দেখা যায় না। – দেবতার মূর্তি বা কোনও মন্দির নেই। পাহাড়ভূমির কাছাকাছি একটি জলপূর্ণ গর্তের মধ্যে ডুবে আছেন পাঁচটি বিভিন্ন মাপের শিবলিঙ্গ। এ দেবতাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুভবে বুঝে নিতে হয়। কোনও শিবলিঙ্গের কি আকার উপভোগ করতে হয় হৃদয় দিয়ে! দু’ পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে অবিরাম জলধারা নেমে আসছে। সামনের পাহাড়ি চাতালে দেবার্চনা চলছে, মাথার উপরে কোনও ছাদ নেই।
চাতাল ঘিরে ছোট বড় দোকানে মনিহারি জিনিষ থেকে পুজোর উপকরণ সবই বিক্রি হচ্ছে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমরাও জলাধারের পাশে বসে দেব দর্শন বা স্পর্শ সাঙ্গ করে ঠিক করলাম, পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে আমরা আরও একটু উপরে উঠবো। ছোট বড় পাহাড়ী টিলায় ঘিরে আছে চারদিক। দেবস্থান ছাড়িয়ে জঙ্গলের বুক চিরে তিন কিলোমিটার হেঁটে গেলে কন্টকুইলি পাহাড়।
একজন গাইড জোগাড় করে তাঁকে অনুসরণ করে আমরা এগোতে লাগলাম। বনভূমিতে ছেয়ে আছে
আকাশ্মনি, আম, শিরিশ, কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, বুনোটগর, কাঁটা ইত্যাদিতে। আরও কত যে নাম না জানা গাছ!
শীতকাল হওয়ার সুবাদে আকাশ খুবই ঝকঝকে। রংবাহারি নানা পাখী আর তাদের মিষ্টি ডাকে, চোখে আর প্রাণে দোলা লাগে। দূর হয়ে যায় সাইকেল চালানোর সমস্ত অবসাদ। জঙ্গলে কিছুটা এগোতে জাগ্রত মা বনদূর্গাদেবীর ছোট মন্দির, আর একটু এগোতেই চারপুরিয়া ঝর্ণা। বন্যজন্তুরা, বিশেষ করে হাতির দল এখানে জল খেতে আসে।
এবার ফেরার পালা। আমরা পায়ে পায়ে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া সেরে একটু জিরিয়ে ফের সাইকেল নিয়ে রেমুনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। রেমুনার দেড়শো বছরের পুরনো ক্ষীরচোরা গোপীনাথের মন্দির কমিটির পান্থশালায় আজ আমাদের রাত্রিবাস। পড়ন্ত বেলায় ক্ষীরচরা গোপীনাথের মন্দির অতীব সুন্দর। গোপীনাথ নাকি এখানে ক্ষীর চুরি করে খেয়ে ছিলেন। প্রতিদিন ১০০ সের দুধ এখানে ক্ষীর হয় ও সেটা নির্ধারিত দামে নির্দিষ্ট মন্দির কমিটি বিক্রি করে। আমরা সকালে সেই ক্ষীরের আস্বাদন আনন্দের সাথে গ্রহণ করলাম। রাত্রে গোপীনাথের মন্দিরে আমাদের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা হলো।
এবার ঘরে ফেরার পালা। পরদিন সকালে রেমুনাকে বিদায় জানিয়ে আমাদের গন্তব্যে ফিরতে আবার সাইকেলে উঠে বসলাম। ঘরে ফিরে এসে ভাবলাম, যা পেলাম তা না পেলে বোধহয় অনেক কিছুই অপূর্ণ থেকে যেত।