আজ শোনাবো লালমাটি, শালবন আর ঝুমুর নাচের আবেশে মাখামাখি পুরুলিয়ার (Purulia) কথা।
পথের বাঁকেই “জাহের থান”। বড় বড় তিন চারটে শাল গাছের নিচে বেড়া দিয়ে ঘেরা সেই জায়গা। লাল কাপড়ের মন্ত্রপূত ধজ্জা উড়িয়ে জানান দিচ্ছে ঠাকুর থান। পিছনে ধু ধু মাঠ একলা পরে আছে দুপুরের বিহানে। নিস্তব্ধ মেঘ্লাবেলায় ঢেপচু পাখি ডেকে চলে একা। হাওয়া বয়।
ওপর পারের জমিতে হরেক রঙের শেড। লাল মাটির সাথে সক্ষতা সবুজ ঘাসের। খানিক দূরে ধান ক্ষেতের ঢেউয়ে হালকা সবুজ, ফিকে সবুজ, গাঢ় সবুজ, হলুদ, হালকা হলুদ… দূরে পাহাড়ের দাঁড়া। রাঙা গ্রামের শেষ এখানেই আবার উল্টোদিক দিয়ে শুরুও বটে। “তারপানিয়া”র ঘনশ্যাম-এর বাড়িতে যখন এসেছিলাম, কথায় কথায় জানা এই থানের কথা। আশেপাশের পাঁচটা বনপাড়ার কথা শোনে থানের ঠাকুর। আতপ চাল ও ছাগ বলির নৈবেদ্যে খুশি থাকে “জাহের” ভগবান।
রাঙা ছেড়ে এগোলেই তেলিয়াভাষা গ্রাম। ঘন জঙ্গলে মোড়া সহজ জনপদ। অপূর্ব পাহাড় জঙ্গলের স্ট্রেচ। উপর থেকে দেখা যায় সর্পিল রাস্তা, অরণ্যের বুক চিড়ে মিলিয়েছে দূরের সমতলে। আঁকাবাঁকা এই রাস্তাগুলোই গিয়েছে কোনটা মাঠা,কোনটা অর্ষা আবার কোনটা বাঘমুন্ডির দিকে। অযোধ্যা পাহাড় ঘিরে রয়েছে রঙ্গিন, সহজিয়া গ্রামের নকশিকাঁথা, যা শহুরে কেজো মানুষদের দুদণ্ড শান্তির অব্যর্থ দাওয়াই।
সকালের এল ফোঁটার আগেই অযোধ্যা (Ajodhya) বনবাংলো ঝোড়ো হওয়ার আয়ত্তে। সুবিশাল শাল, ইউক্যালিপটাস, মহুয়ার ঝুটি নাড়িয়ে দিচ্ছে বনবাতাস। মেঘাছন্ন আকাশের শেষ প্রান্তে “মাজিদী” গ্রামে ব্যাস্ততা কম! ঠান্ডা আবহে সব কেমন জুবুথুবু। কাঠঠোকরা ও ঝিঁঝিঁর কনসার্ট এ ঝিমঝিম অরণ্যের হাতছানি। বাংলোর পাশের রাস্তাটা হারিয়েছে গহীন বনের ইশারায়। রাতে এখানেই রহস্য ঘুরপাক খায়।
এলিফ্যান্ট কোরিডোর (Elephant corridor, Purulia) এই রাস্তা, জানালেন রেঞ্জর (ranger) সাগর চক্রবর্তী। অযোধ্যার (Ajodhya) বনবাংলোকে ঝাঁ-চকচকে করে গড়ে তোলার মূল কারিগর এই বর্ষীয়ান বনাধিকারিক। কেয়ারী করা হরেক ফুলের বাগান, বনঔষধি গাছ, বনসাই ও দুর্দান্ত এক নার্সারি আরো আকর্ষিত করেছে বনবাংলোটাকে। নেপথ্যে সেই সাগর বাবু।
বেলাশেষের দুরন্ত হাওয়ায় এসে দাঁড়িয়েছি, “উসূলডুঙরি”র ভিউপয়েন্ট এ (usuldungri viewpoint, Purulia)। নৈসর্গিক দৃশ্য!সবুজ, ধুসুর সবুজ, ধুসুর, কালচে পাহাড়ের ঢেউ ভাঙছে পড়ন্ত বেলার আলোর সাথে। হু হু বাতাসে হিমেল ছোঁয়া। মনে হয় যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েছে। নিচে, দূরে ছোট ছোট বনগ্রামের সংবদ্ধ উপস্থতি।
হাই ফরেস্ট জোন, উসূলডুঙরির (usuldungri, Purulia) জঙ্গল। হাতি ও লেপার্ড এর স্বাভাবিক চারণভূমি। রাতে এই সব জঙ্গলেই শুরু হয়ে যায় খুনখারাপির খেলা। কাটনেওয়ালারা অবলীলায় জোগাড় করে তাদের রাতের ডিনার। নিরামিষাশীদের আর্তনাদে ভঙ্গুর খোলার চালের ঘরে আদিবাসী মা আরো শক্ত করে আগলে, জাপ্টে ধরে বুকের ভিতর তার শিশু সন্তানকে।
বনপাড়াগুলোতে ঘর পরিষ্কার, রঙ ও সাজানোর প্রস্তুতি চলছে। কাল বাদে পরশু “বাঁদনা পরব”। “বাঁদনা” হলো প্রভৃতি জনজাতি, উপজাতিদের কৃষিভিত্তিক উৎসব। কালীপুজোর পরদিন পালিত হয় বাঁদনা সাধারণত, আবার জেলাভিত্তিক বিভিন্ন সময়ও হয় এই পরব। “অহিরা” গানের মাধ্যমে গোঠপুজো, কাটিজিয়ারি, জাগরণ, গরয়া-গোসাই পুজো, গরুখুটা ইত্যাদি আচার অনুষ্ঠানের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয় এই পরব। পাড়া সাজানোর প্রক্রিয়া ও রঙের বৈচিত্র দেখলে মন খুশি হয়ে যায়।
আজ ফেরার পালা। অযোধ্যা পাহাড়কে বেষ্টন করে প্রচুর ঘোরার জায়গা। লেক, dam, অরণ্য, পাহাড়, বনপাড়া, নাচ-গান… কি নেই বাংলার এই প্রান্তিক জেলায়! ছৌ নাচ ও মুখোশের জন্য বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ পুরুলিয়া। থাকা-খাওয়ার জন্য প্রচুর homestay তৈরী হয়েছে জেলার আনাচে-কানাচে। সড়ক ও রেল যোগাযোগও সহজ।
গাড়িতে ওঠার আগে এগিয়ে যাই গোপীদার কাছে। বৃদ্ধ বনচৌকিদারের চোখে জল!! আলিঙ্গনে আলাদা ওম অনুভব করি! কথা দি, গোপীনাথ মাহাতোর হাতের দুর্ধর্ষ রান্না খেতে আবার আসবো অযোধ্যার (Ajodhya, Purulia) বনবাংলোতে।
বাংলো চত্বর ছাড়াতেই সেই ঢেপচু পাখি ডেকে ওঠে, “টাও, টাও”।।