দেবভূমি উত্তরাখন্ড (Uttarakhand)। আযুগান্তকাল থেকে পূণ্য ও প্রকৃতি-প্রেমিক মানুষের কাছে অতিপরিচিত এক প্রদেশ। গিয়েছিলাম প্রকৃতি ও আধুনিক সভ্যতার লড়াইয়ে পর্যুদস্ত নিরপরাধ সাধারণ অথচ কঠিন পরিশ্রমী কিছু ভূমিপুত্রদের পাশে দাঁড়াতে আর তাদের পুনঃপ্রতিস্থাপনে সামিল হতে। তবে তা করতে গিয়ে যা দিয়েছি, ফেরত পেয়েছি তার শতগুণ। পেলাম অচেনা পরমাত্মীয় মানুষগুলোর উষ্ণ আতিথেয়তা, পেলাম সরল জীবনযাপনের মধ্যে শঙ্কাহীনভাবে সুখী থাকার গোপন মন্ত্র। তবে সেসব ভারী আলোচনা আজ থাক। আজ সবার সাথে ভাগ করে নেব উত্তরাখণ্ডে (Uttarakhand) আমার পরমপ্রাপ্তি – চেনা দেবভূমির প্রায় সবার অচেনা কিছু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর। গ্যারান্টি দিতে পারি ব্যতিক্রমী কিছু নেচারলাভার ছাড়া আমাদের অধিকাংশই তার খবর জানিনা। আসুন ঘুরে আসি।
একটা গাড়ি ভাড়া নিন দেরাদুন (Dehradun) থেকে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ুন আর মুসৌরির (Mussoorie) রাস্তা ধরে প্রবেশ করুন হিমালয়ের স্বর্গরাজ্যে। তবে আমরা মুসৌরিতে মোটেই থাকবো না; অনেক থেকেছেন হনিমুন বা বন্ধু/ফ্যামিলি ট্রিপে। মুসৌরিতে ব্রেক নিতে পারেন। তারপর ধনৌল্টি (Dhanaulti) রাস্তায় এগিয়ে চলুন। ফেলে আসা দেরাদুন (Dehradun) শহরটাকে ডান দিকে নিচে বার্ডস-আই ভিউতে দেখে নিতে নিতে সামান্য এগোলেই পাবেন একটা টি-জয়েন্ট, নাম সুয়াখোলী (Suwakholi)। ধনৌল্টি খুবই বিখ্যাত জায়গা, আলাদা করে বললাম না। কারণ আমরা অফ-বিটের খোঁজে বেরিয়েছি। সুয়াখোলী থেকে সোজা লেফট টার্ন নিন – আপনার অফ-বিট ট্রাক শুরু! জঙ্গলে ঢাকা রাস্তা সরু হলেও যথেষ্ট ভালো। প্রচুর হেয়ারপিন টার্ন হয়ে নিচে নামতে থাকবেন। আশপাশের গ্রামের নামগুলোও পরিবেশটার মত মিষ্টি – রুতু-কে-বেলি, কিথ্, বামসী, ফেরি-কি-মোরা, আলমাস…।
আলমাসই এই রাস্তার লোয়েস্ট পয়েন্ট সংকীর্ণ কিন্তু ভীষণ সুন্দর, নামনাজানা নদীর ধারে। এখান থেকে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে – একটা সম্পূর্ণ 360° ঘুরে চলে গেছে তেহরি গারোয়ালের (Tehri Garwal) সদর শহর তেহরির দিকে। এখন অন্যটা ধরে চলুন নদীটাকে ডাইনে রেখে সোজারাস্তায়। অল্প সময়েই পৌঁছে যাবেন থথ্থুড়ে (Thatyur)। নাম শোনেননি তো? এটা আমার বেস স্টেশন ছিল। নামে ব্লক হেডকোয়ার্টার হলেও এটাকে কোনভাবেই টাউন বলা যাবেনা, জাস্ট একটা বড় গঞ্জ। আসলে, এটা মুসৌরি পাহাড়ের যেদিকে দেরাদুন ঠিক তার উল্টোদিকে। খোলা জায়গা থেকে আপনি দূরে মুসৌরি টাউন আর টপ দেখতে পাবেন। মেইন যে রাস্তায় এলেন সেটা আবার অনেকটা ঘুরে গিয়ে মুসৌরি-উত্তরকাশী (যমুনোত্রী) (Uttarkashi) রাস্তায় মিশে যাবে। বলে রাখি, দেরাদুন-থথ্থুড় লোকাল শেয়ার পাবেন দেরাদুন বাসস্ট্যান্ডের বাইরে থেকে।
থথ্থুড়ে (Thatyur) আমার জানা তিনটে হোটেল আছে থাকার জন্য। বেস্ট হোটেলটা থথ্থুড়ের একদম শেষে অন্য একটা নদীর ধারে, লোকেশনটা দারুন। ‘কৃষ্ণা প্যালেস’ একদম বাজারের মধ্যে লোহার ব্রিজ পেরিয়েই। তবে আমি এখানে 10 মাসের মধ্যে মাত্র একরাত ছিলাম – খাটে ছারপোকার জ্বালায়। আরেকটা ভালো ব্যবস্থা হল ‘হোটেল দেবভূমি’, থথ্থুড়ে ঢুকেই থথ্থুড়ের (Thatyur) একমাত্র ব্যাংক SBI ব্রাঞ্চের উপরে।
বাকিদিনটা এখানে জাস্ট হেঁটে বেড়ান নদীর ধার ধরে। আরেকটা এক্সক্লুসিভ একোমোডেশন হল থথ্থুড়ের নদীর উলটো পারে পাহাড়ের মাথায় PWD-র বাংলো। সম্পূর্ণ একাকী ও নির্জন, অসাধারণ ভিউ আর ব্যবস্থা, তবে জলকষ্ট আছে আর বাংলো ছাড়া একটাও দোকান বা ঘরবাড়ি নেই। থথ্থুড় একটা জাংশান পয়েন্ট অনেকগুলো পাহাড়ি গ্রামের রাস্তায় যাবার জন্য। তবে তার জন্য নিজের দুই পা আর কিছু জায়গার জন্য রিজার্ভ জিপ-ই একমাত্র ভরসা।
পরেরদিন জিপ বুক করে চলুন অজ্ঞাতবাসের পথে। পাহাড়ি ভাঙাচোরা আর মোড়-খাওয়া চড়াই রাস্তা ধরে উঠতে থাকবেন ভূঁইয়াসারীর (Bhuyansari) দিকে। তারপর কিনসু গ্রাম পেরিয়ে আরো উপরে। থথ্থুড়ে (Thatyur) তুষারপাত না হলেও কিনসু এলাকা থেকেই তা হয়। উঠতে থাকুন আরো উপরে, লক্ষ্য দেবলসারী ফরেস্ট রেস্ট হাউস (Devalsari forest rest house)। থথ্থুড় থেকে মাত্র ঘন্টা কয়েকের দূরত্ব হলেও বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছতে হবে কারণ শেষ অংশটুকু ঘন দেবদারু জঙ্গলের মধ্যে হেঁটে যেতে হবে।
পৌঁছে গেছেন আপনার একান্ত ব্যক্তিগত বনবাসের আস্তানায়। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ পাহাড় এখন রিফরেস্টেশনের দয়ায় পাইন-চিঁড় জঙ্গল হলেও এইটুকু এখনো বিশাল দেবদারু গাছের নিবিড় আদরের আচ্ছাদন বাঁচিয়ে রেখেছে। জায়গাটা নিজেই আপনাকে হারিয়ে নিয়ে যাবে। পাহাড়ি পাখির কূজন, সারিবদ্ধ সৈনিকের মত দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু বনের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাওয়া পাগলা হাওয়া, অরণ্যের গা-ছমছমে বুনো গন্ধ আর দিনের বেলা হাতেগোনা কয়েকজন লোকাল কর্মচারী ছাড়া আর কেউ আপনার সাধনভঙ্গ করতে আসবে না। মোবাইলও ‘ডেড-সাইলেন্ট’ এখানে। আর রাত !?!? সঙ্গী/সঙ্গিনীর চেয়েও মধুর আর অলীক নিজেকে অনাবৃত করা এখানে। কথা দিতে পারি এত কোজি লাক্সারিয়াস (বিদ্যুৎহীন) ব্যবস্থার সাথে এমন অপরূপ আদিমতার সহাবস্থান আপনি খুব কম জায়গাতেই পাবেন।
পূর্ণিমা রাতে এখানে থাকতে চাইলে প্লিজ, আপনার ফ্যামিলিকে জানিয়ে যাবেন, চন্দ্রাহত উন্মাদ হয়ে গেলে আপনাকে উদ্ধার করার জন্য। আমার খুব ইচ্ছা মাননীয় বুদ্ধদেব গুহ মহাশয়ের সাথে ওখানে অন্তত এক রাত কাটানোর – “বন জ্যোৎস্নার সবুজ অন্ধকারে”-র আবার নতুন পর্ব পাওয়া যাবে নিশ্চিত। একটা সাবধানবাণী: প্লিজ, রাতের বেলা খুব সতর্ক হয়ে ঘরের বাইরে বেরোবেন আর বাংলোর চৌহদ্দির বাইরে বুকের পাটা না থাকলে না বেরোনোই ভালো!! মানুষ নয়, বন্যপ্রাণীর বেশ ভালো আনাগোনা আছে এই অঞ্চলে – প্রধানত চিতাবাঘ আর বুনো শুয়োর। কয়েকটাদিন এখানে শুধু নিজেকে সময় দিন, অকৃত্রিম অনাবিল প্রকৃতি তো আছেই আপনাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরার জন্য – শুধু তার আত্মসম্মানে আঘাত করবেন না।
দেবলসারীর (Devalsari) ঘোর কাটাতে এরপরে থাকলো আরেকটা অপরিচিত অথচ অসাধারণ ভিউ পয়েন্টের সুলুক সন্ধান। টিংলিং পয়েন্ট (tingling point)। 180° হিমালয়ান মাউন্টেন রেঞ্জ-এর দর্শন পাবেন জনসমাগম ছাড়াই। পথ যথেষ্ট সুগম। জায়গাটা আলমাস-তেহরি রোডের উপরে। থথ্থুড় থেকে দুটো রাস্তায় যেতে পারেন। প্রথমত, থথ্থুড় থেকে আলমাস মোড় পর্যন্ত ফিরে যান, তারপর মুসৌরি-ধনৌল্টির রাস্তায় চড়াই না করে সোজা বেরিয়ে যান তেহরির দিকে নদীকে এবার বামহাতে রেখে। কোন দিকনির্দেশ লাগবেনা। রাস্তা ভালো, নিজেই বুঝতে পারবেন যখন টিংলিং (tingling) পৌঁছাবেন। এটা একটা রিজ-এর টপ। মাত্র গুটিকয়েক হাতেগোনা চা/স্ন্যাকসের দোকান। এখানকার দৃশ্যের বর্ণনা করা আমার ভাষায় কুলোলো না। যতক্ষণ খুশি কাটান, কোন ভয় নেই। আমি রাত একটা-দুটোর সময়ও মদীর চোখে ওখানে কাটিয়েছি।
টিংলিং যাবার আরেকটা একটু ডেয়ারডেভিল রাস্তা আছে। থথ্থুড় থেকে যে নদীর ডানপাশ ধরে এলেন তার বামপাশ ধরে বান্দাচক-মেঢ়-ডাঙ্গু-সাবলি হয়ে মাখদেত-এ আবার উপরের রাস্তায় মিশবে। তবে, এই রাস্তা প্রধানত চড়াই কাঁচা/ভঙ্গুর আর ধ্বসপ্রবন। তাই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। এটার উপরি পাওনা হলো প্রকৃতির অন্য রূপ আর গ্রামগুলো। টিংলিং পয়েন্ট থেকে দুদিকে ফিরতে পারেন। একটা হল, আরও এগিয়ে ভাগীরথীর উপর বিশ্ববিখ্যাত তেহরি ড্যাম (Tehri dam) পেরিয়ে তেহরি টাউন, সেখান থেকে কেদার-বদ্রী (Kedar-badri) রুট ধরে ফিরে যেতে পারেন ঋষিকেশ/হরিদ্বার/দেরাদুন। আর অন্যটা হল আলমাস (Almas) ফিরে এসে মুসৌরির (Mussoorie) রাস্তা ধরা।
পরিশেষে বলি, হাতে যদি একটু সময় বাঁচে তো থথ্থুড় (Thatyur) থেকে চড়াই ভেঙে কাছাকাছি পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা কোন গ্রামে যেতে পারেন। গ্রামীণ পাহাড়ি মানুষগুলোর অকৃত্রিম সারল্য আর উষ্ণ আতিথেয়তা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। হিমালয়ের অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এদের ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকে।
ও হ্যাঁ!! আরেকটা কথা উল্লেখ করি। যদি আপনি পোক্ত ট্রেকার হন তবে থথ্থুড় থেকে ঠিকমল, দুগাড্ডা, ডিগন পর্যন্ত গাড়িতে গিয়ে ওখান থেকে অত্যন্ত ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেকিং করে নাগটিব্বা অভিযান করতে পারেন। তবে সেটা পোক্ত আর পরিশ্রমী ট্রেকারদের পক্ষে সম্ভব। তাই সে গল্প “অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে”, অন্য সময়ে।
আমার এ লেখা পড়ে কেউ যদি সত্যিই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা উপভোগ করেন তবেই লেখাটির সার্থক বলে মনে করব। ঘুরে এসে অবশ্যই জানাবেন কেমন লাগলো!
Baah! Onek na jana tothyo pelam. Amra koyekjon 2017 e odikey gechilam din doshek er jonye, kintu ekhon mone hochchey jaoar agey ei lekha ta porey gele ar aro jomto. Dhonyobad Sajalbabu. Porer lekhay North east niye kichu porar ashay thaklam.
অনেক ধন্যবাদ অজয়বাবু। ঘুরে এসেছেন তো কি হয়েছে, আবার নাহয় যাবেন। প্রেয়সীর সাথে কি একবার রসালাপে মন ভরে ?!?! আর প্রকৃতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রেয়সী আর কেই বা হতে পারে !!! আবার চলুন অভিসারে।
আপনার অনুরোধ মনে রাখলাম, চেষ্টা করবো। আপনাদের ভালোলাগার শব্দ হয়ে দাগ কাটে আমার কলমের টানে।
Achcha debolsari forest bunglow ta ki shadharon manush book kortey parey? Jodi kora jay tahole janaben ki bhabe korbo?
Apnar lekha pore ichche hoyechey amra shoporibare ghure ashi ekbar.
আপনি তেহরি গাড়োয়ান District Forest Dept. এ যোগাযোগ করুন ওটা ওনাদের নিয়ন্ত্রণে।