১) দার্জিলিং (Darjeeling) জেলায় অবস্থিত ঘুম স্টেশন থেকে মাত্র নয় কিলোমিটারের মধ্যে শান্ত নির্জন স্নিগ্ধ একটি পাহাড়ি গ্রাম লেপচা জগৎ (Lepcha Jagat)। হোটেল বলতে একমাত্র WBFDC ফরেস্ট বাংলো। কিন্তু তাতে কী? মাত্র গোটা দশেক বাড়ি, যেগুলো সবই এক একটি হোমস্টে।
সর্বসাকুল্যে দু’টো দোকান। খাবার বলতে পাবেন চা, কফি, মোমো, ম্যাগি, সিগারেট আর পানীয় জল। ট্রেকিং না করে এত পরিষ্কার করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য এরকম জায়গা পাওয়া দুষ্কর।
গ্রামের চারদিক মুড়ে রেখেছে পাইন গাছের বন জঙ্গল। প্রায় সারা বছর কুয়াশায় মোড়া থাকে এই গ্রাম। মেঘেরা এখানে গাভীর মত চরে। হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় তাদের, ভিজে ওঠে হাত। দিকে দিকে শোনা যায় ফুরুত ফুরুত করে উড়তে থাকা নাম না জানা হরেক পাখির ডাক। বুনো ফুল উঁকি মারে যেখানে সেখানে। প্রকৃতি প্রেমিক ও পক্ষী প্রেমিকদের জন্য এক্কেবারে আদর্শ জায়গা। গ্রামের নিচে দেখা যায় দার্জিলিং শহরকে, যার রূপ রাত্রিতে অনন্য।
২) একদিন হেঁটে বেড়ানোর জন্য এই গ্রামে আপনাকে সময় দিতেই হবে। বড়ই অদ্ভুত এখানকার মানুষজন। যেন জন্মলগ্ন থেকে সবাই চেনা। হেঁটে হেঁটে গহন জঙ্গলের মধ্যে দেখে নেওয়া যায় ঘুম রক। পাহাড়ের মাথায় এক বিশেষ প্রস্তরখন্ড যা প্রায় একশ মিটার উঁচু। রকের প্রান্ত দেখতে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। হাল্কা ট্রেকিং এর স্বাদ মিটবে এখানে। লেপচা জগৎ (Lepcha Jagat) ভিউ পয়েন্টটিও বড়ই মনোরম। গ্রামের মধ্যস্থিত পাহাড়ের টিলায় পরিচ্ছন্ন এক উপত্যকা। বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে দিব্যি সেখানে উঠে পড়া যায়। আপনাকে আহ্বান জানাবে ধাতব চেয়ার আর শূন্য দোলনা। দুর্দান্ত ভিউ দেখে মন ভরে যেতে বাধ্য।
হোমস্টে গুলো সবই রাস্তার দু’পাশে। প্রত্যেকটিই অত্যন্ত সুন্দর। দুর্দান্ত তাদের আতিথেয়তা ও খাবার দাবার। এখানে থাকলে হোটেলে থাকার ইচ্ছে আপনার চিরদিনের মত উবে যেতে পারে। হোমস্টের ট্যারিফ- খাওয়া থাকা নিয়ে ধরে নিন জন প্রতি প্রায় হাজার টাকার কাছাকাছি।
৩) আমরা উঠেছিলাম পাখরিন হোমস্টেতে। দুইতলা বিশিষ্ট এই হোমস্টে এককথায় অসাধারণ। প্রতি রুমে রয়েছে জল গরমের গিজার, আধুনিক টয়লেট। ডানদিকের জানালা খুললেই উঁকি মারে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। নিচের খাদে WBFDC-এর বাংলো। সামনের দরজা অবরূদ্ধ করে দাঁড়িয়ে বিশালাকায় এক পাহাড়। রবিন তামাং-এর পরিবার এই হোমস্টে চালান। তাঁর বৃদ্ধ বাবা মা সব কিছু দেখা শোনা করেন। তাঁদের আচরণ আপনার মনে দাগ কেটে যাবেই। যখন তখন কিচেনে গিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। ভাগ করে নেওয়া যায় ফায়ার প্লেসের উত্তাপ। ডাক দিলেই মিলে যায় গরম পানীয় জল। ভাবার আগেই হাজির হয় অতীব সুস্বাদু দার্জিলিং চা।
৪) এখান থেকে মিরিক (Mirik) বা মিরিক থেকে এখানে আসার অভিজ্ঞতা মিস করলে জীবন বুঝি ব্যর্থ।
অসাধারণ সুন্দর কুয়াশা মাখা এই পথ আজীবন আপনার মনে দাগ কেটে থাকবে। খাদের তলা থেকে উঁকি মারে পাইনের সারি। নিচে গভীর অরণ্য যেখানে সূর্যদেবের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। এ সত্যি অন্য এক জগত। সাইট সিনে জোড়পোখরি, সুখিয়াপোখরি ভিউ পয়েন্ট, গোপালধারা টি গার্ডেন ও মিরিক লেক – মিস করা ঠিক হবে না। মিরিক থেকে লেপচা জগৎ-এর পথটি স্বপ্নের মত… আমার বর্ণনার অতীত। কাছেই নেপালের পশুপতি মন্দির (Pashupati Mandir) ও মার্কেট। পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে সহজেই ভিনদেশে। পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই লাগবে না। যাঁরা কখনও বিদেশ যাননি, তাঁদের জন্য এ এক সুবর্ণ হাতছানি।
৫) রিজার্ভ গাড়ি এখানে সহজলভ্য। দার্জিলিং (Darjeeling) ও এন জে পি (New Jalpaiguri) যাওয়ার শেয়ার গাড়িও প্রচুর। শেয়ারে দার্জিলিং থেকে জন প্রতি ৪০ টাকা, আর এন জে পি যেতে ২০০ টাকা। মিরিক (Mirik) হয়ে দার্জিলিং-এর পথে সাইট সিন সেরে দুই রাত্রির যাপনের জন্যে একেবারে আদর্শ জায়গা। আপনি অবশ্য উল্টো রুটেও কভার করতে পারেন।
তিন ভাবে এখানে পৌঁছোনো যায়।
এক) ২০০ টাকা দিয়ে এন জে পি অথবা শিলিগুড়ি (Siliguri) জংশন থেকে শেয়ার গাড়িতে ঘুম স্টেশনে নেমে আরও একটা শেয়ার গাড়িতে ৩০টাকা দিয়ে আসতে পারেন এখানে।
দুই) এন জে পি থেকে টোটো বা অটোয় শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড(জংশন)। শেয়ার গাড়িতে মিরিক, জন প্রতি ১০০ টাকা। ওখান থেকে লেপচা জগৎ মাত্র ২০০ টাকা (শেয়ারে সাইট সিন করতে পারবেন না)। মিরিক থেকে রিজার্ভ গাড়িতে সাইট সিন সেরে লেপচা জগৎ দু’হাজার টাকার মতো।
তিন) এন জে পি ছুঁয়ে রিজার্ভ কার সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো, ঘুম হয়ে গেলে আড়াই হাজারের আশেপাশে।
৬) হাতে তিনদিন সময় থাকলেই দিব্যি মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া যায় লেপচা জগৎ-এর (Lepcha Jagat) কোলে। মিরিক হয়ে সাইট সিন সেরে লেপচা জগৎ-এ দুই রাত্রি যাপন। শেষ দিন দার্জিলিং ম্যালে কাটিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি ফেরা..যেটা আমি করেছি। আপনি অবশ্য উল্টো পথেও সেটা করতে পারেন।
শেষদিনে মনখারাপ হওয়া খুব স্বাভাবিক। তবে মনে মনে আপনাকে প্রার্থনা করতেই হবে- ভাল থাকুক লেপচা জগৎ (Lepcha Jagat), ভাল থাকুক এখানকার মানুষজন। সময় হলে আবার ফিরে আসব এই স্বপ্নের জগতে… বারবার।