একটা সময় ছিল যখন বাঙালীর ভ্রমণ, দার্জিলিং ছাড়া কল্পনা করা যেত না। তবে এখন সে কল্পনায় কিছুটা হলেও মরচে ধরেছে। কারণ অনেকের মতে দার্জিলিং নাকি আজকাল ওভার হাইপড! ম্যালে লোকজনের কোলাহল, ভিড়, ঘিঞ্জি আর নোংরা। দার্জিলিং আর আগের মতো নেই। তাই একটু অন্যরকম রান্নায় স্বাদ বদল করে দেখা যাক।
‘নাতিশীতোষ্ণ’ শব্দটা অভিধানে খুঁজলে, এরকম একটা অর্থ নজরে পড়ে- অতি শীতলও নয়, অতি উষ্ণও নয়। অর্থাৎ যা বেশী গরমও নয় অবার খুব বেশি ঠান্ডাও নয়। কিন্তু এই রকমের আবহাওয়ায় অবস্থিত কোন জায়গা যদি বলি এই রাজ্যের মধ্যে তাহলে প্রথমেই যে নামটা মনে পড়ে, তা হল কালিম্পং। কলকাতা থেকে অল্প দূরে আবার দার্জিলিঙের মতো জনবহুলও নয়। অথচ প্রকৃতি এখানে তার শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যটুকু দিতে কিন্তু কোন রকম কার্পণ্য করেনি।
ছোট্ট একটা পাহাড়ী শহর ভালবাসা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে স্বল্প পরিসরের আনন্দ পেতে সপ্তাহান্তে নিঃসন্দেহে ঘুরে আসতে পারেন এরকম একটা হিল স্টেশনে। তবে এই জায়গার সম্পূর্ণ পাহাড়ী ভালোবাসা আহরণ করতে, হাতে বেশ কয়েকটা দিন নিয়ে যাওয়া আবশ্যক।
আগে কোনমতে জলপাইগুড়ি পৌঁছানোটা দরকার। সেটা বাগডোগরা হয়েই হোক বা শিয়ালদহ বা হাওড়া থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। তারপর শেয়ার্ড গাড়ি, ফুল রিজার্ভ করা বা প্রি-পেড গাড়ির ব্যবস্থা আছে। অথবা তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস/গাড়িতে সিকিম হাইওয়ে ধরে কালিম্পঙের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু। শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ী রাস্তার শুরু হওয়া মাত্র চারপাশের ছবির পরিবর্তন, হাওয়া বদল আর তাপমাত্রার হেরফের লক্ষ করার মতন। সব মিলিয়ে যেন শহুরে জীবন থেকে একেবারে ছুটি।
পথে যেতে যেতে একে একে পড়বে সুনতালে, কলিঝোরা। সুনতালেতে সিজনে রাস্তার ধারে নজরে পড়বে সারি সারি কমলালেবু গাছ। কারণ এখানে ভীষণ ভালো কমলালেবুর চাষ হয়। আর কিছুটা পেরিয়ে যত এগোব, পথে পড়বে হনুমানঝোলা, লোহাপুল। আবহাওয়ার পরিবর্তন হবে তত। আর এই যাত্রার সবচেয়ে প্রিয় মনখারাপের সঙ্গী তিস্তা তো আছেই। রামবিবাজারে খুব মাশরুম চাষ হয়। কপাল ভালো হলে, হয়তো নজরে পড়বে কোন বাচ্চা মেয়ে গ্রাম থেকে আনা একদম টাটকা মাশরুম নিয়ে বসেছে।
মাঝে বলে রাখা প্রয়োজন কালিম্পং যাওয়ার আদর্শ সময় হল, অক্টোবর থেকে মার্চ। শীতে কাঞ্চনজঙ্ঘা যেমন ভালোভাবে দেখা যায়, বুদ্ধ পূর্ণিমায় কালিম্পং শহরে খুব সুন্দর উৎসব হয়। মানুষের ঢল নামে পাহাড়ী রাস্তায় আর তারা মিছিল করে এগিয়ে যায় মনাস্ট্রির উদ্দেশ্যে। এনজেপি থেকে কালিম্পং পৌঁছতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। চারপাশের প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে কখন যে ঘড়ির কাঁটায় তিনটে ঘন্টা পেরিয়ে যাবে টের পাবেন না। যাওয়ার আগে এমন ভাবে প্ল্যান করে যাবেন, যাতে শনিবারটা কালিম্পঙে থাকতে পারেন। কারণ কালিম্পং শহরে হাট বসে শনিবার।
শাক সবজি থেকে শুরু করে নুডুলস, গরম পোশাক সবকিছু নিয়ে বসেন গ্রামের মানুষ। বেশ অন্যরকম ব্যাপার, ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগবে। কেনাকাটা করতে পারেন। মধু, বিস্কুট খুব ভালো এখানে। স্পিন্যাচ, পাস্তাও দারুণ, দামে সস্তা। আর ভালো লোকাল চিজ় পাওয়া যায়।
কালিম্পং টাউনের কাছাকাছি থাকার জায়গা পেতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। কাছেই মার্কেট আর বাসস্ট্যান্ড এবং টাউন হল। কাছাকাছি ঘোরার জায়গা প্রচুর। পাইন ভিউ নার্সারি, এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম ক্যাকটাসের সংগ্রহ ঐই নার্সারিতে। এখানকার মূল আকর্ষণঃ মনাস্ট্রি ! দূরপিন দারা হিলের মনাস্ট্রিতে একবার গেলে মন ভালো হয়ে যায়। দেখতে যাওয়া যেতে পারে সেন্ট টেরেজা়স চার্চ।
একটু গা ছমছমে অভিজ্ঞতার জন্য অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন ১৯৩০ সালে মিস্টার ও মিসেস মর্গ্যানের তৈরী করা “মর্গ্যান হাউস”। এটি এক সময় ব্রিটিশ প্রপার্টি ছিল। চাইলে এখানে দু এক রাত কাটাতেও পারেন নিঃসন্দেহে। তবে আগে বুকিং করে না গেলে পাওয়া মুশকিল কারণ বাড়িটি বর্তমানে ওয়েস্ট বেঙ্গল টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের অধীনে। মর্গ্যান হাউসের ঠিক উল্টো দিকে নজর কাড়া দৃশ্য পাওয়া যাবে আর্মির গল্ফের মাঠে। পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই গল্ফের মাঠ আর তার সৌন্দর্য ছেড়ে ফিরে আসতে কষ্ট হয়।
পরদিন সকালে একটি স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে প্রথমে রওনা দিন ডেলো পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। পথে পড়বে একটি দেখার মতো সুন্দর পদ্মাসনে বসা গৌতম বুদ্ধের মূর্তি ও পার্ক। এই পথেই পড়বে শেরপা ভিউ পয়েন্ট ও দূর্গা মন্দির। প্রায় ৫৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কালিম্পং শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গা হল এই ডেলো হিল। ডেলো কটেজের পাশাপাশি এখানে আছে নিজস্ব রেস্তোরাঁ এবং প্রায় আট একর জমি জুড়ে পার্ক ! এলাকার সৌন্দর্য অভূতপূর্ব।
পার্কটি বাচ্চাদের খেলার জন্য এবং পিকনিক করার জন্য আদর্শ। এখানে কিছু স্ন্যাক্স ও কফির দোকানও আছে। ফেরার পথে অবশ্যই ঘুরতে ভুলবেন না “ডঃ গ্রাহামস হোম”। ১৯০০ সালে ৫০০ একর পাহাড়ী জমি জুড়ে ডঃ জে এ গ্রাহাম-এর বানানো একটি মিশনারি স্কুল ও অনাথাশ্রম। সম্পূর্ণ স্কুল এলাকাটি ঘুরে দেখাও যায়। তাঁর প্রাকৃতিক শোভা দেখে ভাবা যায় না যে স্কুলও এত সুন্দর হতে পারে।
কালিম্পং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন বা ওখানকার চারপাশের পরিবেশ ও সৌন্দর্য লিখে বর্ণনা করা কঠিন। ওটা দেখেই উপভোগ করার মধ্যেই সম্পূর্ণ স্বার্থকতা। তবে দিনের শেষে ভুরিভোজের চিন্তা করাটাও প্রয়োজন। চায়না গার্ডেন রেস্তরাঁতে বেশ ভালো ওয়ানটন পাওয়া যায়। গোম্পুস বার অ্যান্ড রেস্তরাঁ মোমোর জন্য বিখ্যাত।
ফ্রেশ বাইট রেস্তোরাঁয় পাবেন মিসো সুপ ও মনমাতানো বেকন স্যান্ডউইচ। আর ক্যাফের খোঁজ করলে, প্যারিস ক্যাফে বা আর্ট ক্যাফেতে যাওয়া যেতেই পারে। তবে পাকদন্ডী পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়, পথের ধারের দোকানের মোমো খেতে ভুলবেন না। কারণ ওই স্বাদ আর কোথাও পাবেন না। তাই নিরিবিলি একটা ছুটি কাটাতে এর থেকে ভালো কিছু এই বঙ্গে পাওয়া কঠিন।