দৈনন্দিন ব্যস্ততার ফাঁক গলিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে এক অনন্য শান্তির মাঝে গেল ডিসেম্বরে কাটিয়ে গেল এলাম কালিম্পং জেলার পাহাড়ি ভার্জিন গ্রাম পাবং-এ (Pabong)। উত্তরবঙ্গ গেলেই বন্ধু রিতম মাহাতের স্মরণাপন্ন হই। এবারেও রিতম সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমরা দুই পরিবার। আমার আট বছরের মেয়ে সমেত মোট পাঁচ জন।এনজিপি থেকে বাহন টাটাসুমো গাড়ি।
ড্রাইভার অজয়, হিন্দু নেপালি। চৌখোশ ছেলে। দারুণ স্মার্ট। এনজিপি থেকে গাড়ি করে পাবং যাওয়ার পথে পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে বসানো ঘরগুলো, ক্যালেন্ডারের ছবির মতো। অযন্তে বেড়ে ওঠা নানা জানা অজানা ফুলের সাজি আনাচে-কানাচেতে। রঙিন প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে এক ফুল থেকে আর এক ফুলে…। উত্তরে নীলাভ আকাশজুড়ে সূর্যের ছটায় উদ্ভাসিত বরফাচ্ছাদিত সম্রাজ্ঞী কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবী রূপ।
তিন ঘন্টার ছবির মত পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ছিমছাম সুন্দর কাঠের কটেজ, চিত্রকূট ফার্ম হাউস। কটেজের সামনে দিগন্তবিস্তৃত মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা। হোমস্টের হোস্ট সহজ, সরল খড়্গা গুরুং ও তাঁর স্ত্রীর আন্তরিকতায় ভরা আতিথেয়তার পরশ ভোলার নয়। দুপুরের খাবারে হোম স্টের নিজস্ব ফার্মের গাওয়া ঘি, রাই শাক, স্কোয়াশের তরকারি। সঙ্গে ডাল, পাপড় ভাজা, ডিম কষা। অপূর্ব স্বাদ!
খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে ইকো হাটের পিছনের রাস্তা ধরে নিঃশব্দ জঙ্গলের পথ চলা। পাখিরা খুনসুটি করে ডেকে আবার চুপ করে যাচ্ছে…। এলাচ গাছের ঝোপ, ফুলঝাড়ু গাছের দল, লতানো স্কোয়াশ গাছ পাহাড়ের কোল জুড়ে। পাহাড়ের আঁকেবাঁকে মেঘেদের সভা। একটা মেঘ হঠাৎ সামনে এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ল। সারা শরীরে এক অনাস্বাদিত রোমাঞ্চ। ফিরতি পথে, সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে তাড়াতাড়ি।
পায়ের চকিত শব্দে একটা কাঠবিড়ালি ল্যাজ তুলে দৌড় দিল, গাছের ডালে। আমাদের মুখে শেষ বেলার দু’এক ফালি নরম পশমি রোদ। দূরে আগুন রঙা আকাশের নীচে মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা। আসন্ন সন্ধ্যার শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছিল শরীর, মনে। পাখিদের ডাক মিলিয়ে যাচ্ছিল বনের মধ্যে। শুনশান হয়ে আসছিল চার পাশ। অবাক হয়ে পাবংয়ের আকাশে প্রকৃতির রঙিন স্কেচ দেখছিলাম। সবুজ পাতার সঙ্গে রঙ-বেরঙের ফুলের কোলাজ, যেন অস্ত সন্ধ্যায় কবিতা ।
সামনে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি, ছায়া আবছায়া নিয়ে। সারা শরীরে হিমেল হাওয়ার স্পর্শ। সূর্যাস্তের সন্ধ্যানীল আকাশে রুপোলি চাঁদ তুলি হাতে নিয়ে পাহাড়ের ঢালে ঘন জঙ্গল আর আকাশের ক্যানভাসে একটার পর একটা রঙে তুলি ডুবিয়ে বুলিয়ে চলেছে এ পাশ থেকে ও পাশ। একটার পর একটা রঙের বেহিসেবী প্রলেপ।
কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্যদেব পশ্চিম পাহাড়ের ঢালে হারিয়ে গেলেন। গা ছমছম জঙ্গল আর পাথুরে ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে পাবং-এর আস্তানায় যখন এসে পৌঁছলাম তখন জঙ্গলের বুক চিরে এক অজানা পাখির ডাক ভেসে যাচ্ছে। দূরে, আলোকমালায় সজ্জিত সুন্দরী কালিম্পং (Kalimpong), ডেলো (Delo)।
হোম স্টের কেয়ারটেকার রামু সোরেন হাতে ‘ব্ল্যাক টি’-র কাপ ধরিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি কাঠ সাজিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। আমরা বনফায়ারের চারিদিকে বসে আগুনের ওমের স্পর্শে শরীর গরম করতে লাগলাম। গনগনে কাঠের আগুনের উপর লোহার জালি রেখে ম্যারিনেট করা মুরগী রোস্ট হচ্ছে।
বারবিকিউ! মুখে গরম গরম এক টুকরো। ওয়াওও! অসাধারণ স্বাদ! সামনে চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত দিগন্তবিস্তৃত অপরূপা কাঞ্চনজঙ্ঘা। নিঝুম রাতে ঠাণ্ডার পরশে পরিষ্কার আকাশে ঝিকমিক করতে থাকা তারাদের সঙ্গে গল্প করা, চাঁদকে সঙ্গী করে। রাতে গরম রুটি আর জংলী মুরগীর কষা মাংস চেটেপুটে খেয়ে বিছানায় কম্বলের মধ্যে। কটেজের কাঁচের জানালা দিয়ে চন্দ্রিল কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো ভোরে খড়্গা গুরুংয়ের বাবার পুজোর ঘন্টাধ্বনি ও মন্ত্রোচ্চারণে। মিষ্টি নরম একটা লালচে আলো ঘরের জানালা দিয়ে ভিতরে আসছে। বাইরে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াই। ভোরের নরম মোলায়েম সূর্যের রক্তিম আলোর ছটায় উদ্ভাসিত দিগন্তবিস্তৃত স্লিপিং বুদ্ধর অসাধারণ দৃশ্য।
চিরতাপস বরফাচ্ছাদিত হিমালয় যেন কোনও এক অচেনা পাহাড়ি যুবতী মেয়ের প্রেম নিবেদনে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছে..। শুধুই মুগ্ধতা। চোখ জুড়িয়ে যায়। সকাল দীর্ঘতর হওয়ার সাথে সাথে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিং চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রতি মূহুর্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপের পরিবর্তনের সাক্ষী থাকা – এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
পাবং-এ (pabong) হোমস্টেতে বসে চোখের সামনে রাঙা সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত দেখতে মন বারবার ফিরে যেতে চাইবে সেখানে। কোলাহল বর্জিত এই পাহাড়ি গ্রামের কাছেই আরো কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। চার কিমি দূরে চারখোল গ্রাম। খুব কাছেই লাভা, লোঁলেগাও, রিশপ, কোলাখাম, রিকিসুম, পেডং প্রভৃতি সুন্দর পাহাড়ী গ্রামগুলি। এই গ্রামগুলি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোরম দৃশ্য অবর্ণনীয়।
সময়ের চোখ রাঙানিতে গরম জলে স্নান সেরে প্রাতরাশে অতি সুস্বাদু ডিমচাউ খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্যস্থান, কোলাখাম। আমাদের চারচাকা গাড়ি যখন রাস্তার বাঁকে, পেছন ফিরে দেখি খড়্গা গুরুং, তাঁর স্ত্রী আর রামু নিষ্পাপ হাসিমুখে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছেন। বড় মধুর স্মৃতি নিয়ে চললাম।