খবরের কাগজের চাকরিতে সকাল সন্ধ্যা সমান। ভোরে ওঠা নতুন কিছু নয়। কিন্তু বেড়াতে যাওয়ার জন্য
ভোরে ওঠার রোমাঞ্চই আলাদা। নাই বা হলো বড়সড় সফর। একদিনের ছোট সফর, তাই বা মন্দ কী?
তেমনই এক অসাধারণ অনুভুতি হয়েছিল বিজয়া দশমীর (last day of durgapuja) দিনে। এমন নয় যে, খুব আগে থেকে পরিকল্পনা হয়েছিল। দুই বন্ধু পত্নীসহ মোট সাতজনের ছোট একটা টিম। আমাদের এক সহকর্মী প্রশান্তর বাড়ি বসিরহাটে। প্রতি পুজোয় দেশের বাড়িতে যায়। কতবার বলেছে, ‘দাদা বিজয়া দশমীর (bijoya doshomi/vijaya dashami) দিন আমাদের ওখানে একবার চলুন। ইছামতীতে (ichamati river) এপার বাংলা আর ওপার বাংলার প্রতিমা বিসর্জন দেখবেন। একবার গেলে বারবার যেতে ইচ্ছা হবে’। এবার সেই ইছামতীর (ichamati river) কাছেই যাচ্ছি।
ইছামতীর (ichamati) কাছেই টাকি (taki) পুরসভার অতিথি নিবাস। প্রশান্ত আগে থেকেই দুটো ঘর বুক করে রেখেছিল। ঠিক হল আমরা বিজয়া দশমীর দিন রাতে থেকে পরদিন সকাল সকাল কলকাতায় ফিরব।
দশমীর সকালে আমরা শিয়ালদহ (sealdah railway station) থেকে সকাল ৬টা ১২ মিনিটের হাসনাবাদ লোকালে (hasnabad local) উঠে বসলাম। ছুটির দিনে ডেইলি প্যাসেঞ্জার নেই। সিট পেলাম। তবে শুধু আমরা একা নয়, আমাদের মতো অনেকেই বেরিয়ে পড়েছেন। আবার কলকাতায় ঠাকুর দেখে অনেকেই বাড়ি ফিরছে, ফলে ছুটির দিনেও ট্রেনে ভাল ভীড়। ট্রেনে আমাদের অনেকেই গল্প করলেও, বেশিরভাগই মোবাইল ঘাঁটছে। বেড়াতে বেরিয়ে মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা আমার কাছে বিরক্তিকর। আমার চোখ তখন জানলার বাইরে, অনেকটা দুখু মিঞার সেই ট্রেনে চড়ার মতো।
সবকিছু ছুটছে, আমরাও ছুটছি। চারদিকে হলুদ সর্ষের ক্ষেত। এই বুঝি উঁকি দিচ্ছে শাহরুখ-কাজল। এই বুঝি ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে ভালোলাগা সেই সুরগুলো। ইটভাটা, নদী, গাছপালা সব দেখছি। টাকি (taki) পৌঁছতে দুঘন্টা লাগল। স্টেশনে নেমে আমরা একটা মিষ্টির দোকানে প্রাতঃরাশ সারতে ঢুকে, বাড়ির মত লুচির সঙ্গে সাদা আলুর তরকারি দেখে চমকে উঠলে্ও, বেশ তৃপ্তি করেই খেলাম। শেষ পাতে বসিরহাটের (basirhat) বিখ্যাত মিষ্টি। এরপর স্টেশন থেকে রিক্সায় ১৫ মিনিটে পুরসভার অতিথি নিবাস।
ইছামতী (ichamati) বড় অদ্ভূত নদী। বিভুতিভূষনের উপন্যাসে যা অনেকটাই ধরা আছে। কিন্তু এ তো নিছক নদী নয়, দুই দেশের সীমান্ত। এপারটা ভারত, ওপারটা বাংলাদেশ (India-Bangladesh border)। ইছামতীকে দেখার জন্য টাকি পুরসভা সুন্দর করে রেলিং দিয়ে ব্যালকনি তৈরি করে দিয়েছে। মন ভরে উপভোগ করুন। ব্যালকনি থেকে পথে নেমে আপনি পূব দিক বরাবর গেলেই সীমান্ত। একটা অটো ধরে নিন। কিছুটা যাওয়ার পর পথের ডান দিকে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দপ্তর। তবে এরপর যেতে গেলে আপনাকে বৈধ পরিচয়পত্র জমা রেখে যেতে হবে। তবে মিলবে অনুমতি। সেনারা সব স্টেনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে ভরসা আর ভয় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
টাকি শুধু ইছামতির (ichamati) নয়। মাছরাঙা দ্বীপ আছে। যেন বড়ই একাকী। ইচ্ছা করলে আপনি একদিনেই দেখে নিতে পারেন ট্যুরিস্ট স্পট, গোলপাতা জঙ্গল ও টাকির ইকো পার্ক (taki eco park)। পাশাপাশি রায় চৌধুরীদের জমিদার বাড়ি ও বাগানবাড়িও দেখতে পারেন। তবে ইছামতীতে বিসর্জন দেখতে হলে বাকি সবকিছু আপনি একদিনে ভালভাবে উপভোগ করতে পারবেন না।চাই আরও একটা দিন। আমরা দুপুরের খাওয়া শেষ করার পরপরই প্রশান্ত এসে হাজির। সবাইকে একটু বিশ্রামের পরামর্শ দিয়ে বলল, ‘আমরা কিন্তু চারটের মধ্যে ইছামতীর ঘাটে পৌঁছব’।
ছোট একটা ভাত ঘুম দিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আমরা চারটের মধ্যে পৌঁছনোর পর দেখলাম, তখনই
একটা ছোটখাট সমাবেশ হয়ে গেছে। প্রশান্ত ওর দু-একজন বন্ধুকে বলে রেখেছিল। আমরা যেতেই ওরা
বেরিয়ে এসে আমাদের জায়গা করে দিল।
এরপর বেলা যত পড়বে ততই লোক বাড়তে থাকবে। ধীরে ধীরে সূর্য অস্তমিত হয়ে বাংলাদেশের কোলে ঢলে
পড়বে। ইছামতীতে (ichamati) এসে সূর্যাস্ত দেখা উপরি পাওনা। ততক্ষণে ইছামতীর উপর উৎসবের ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। বেজে গেছে বিসর্জনের বাজনা। বিজয়ার দিন সীমান্তে ছাড় দেয় দু’দেশ। ওপার বাংলার নৌকা আসছে এপারে, এপারের নৌকা যাচ্ছে ওপারে। একে অন্যের দিকে ছুঁড়ছেন লেডিকেনি, লাড্ডু। একই সঙ্গে মা দুর্গা (ma durga) এবং পরস্পরকে হাত জোড় করে বিজয়ার প্রণাম ও শুভেচ্ছা বিনিময়। এ এক অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য। কী অপূর্ব মেরুকরণ ! যা না দেখলে সত্যিই জীবনের অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যাবে। প্রায় রাত ন’টা পর্যন্ত ইছামতীর (ichamati) তীরে কাটিয়ে অতিথি নিবাসে চলে এলাম। কাল সকালেই যে ফেরার পালা।
ফিরে আসতে কার ইচ্ছা করে ! কিন্তু আমরা বাঁধা ঘড়ির সেই শাসনে। ভোরের ট্রেনেই ফিরতে হবে। তার
মধ্যে সব গুছিয়ে নিতে হবে। শীতের আমেজ উপভোগ করতে করতে রাতে হাল্কা খাবার খেয়ে ঘুম।
তবে মাংস নয়, মাছ। ইছামতির (ichamati) নানারকম মাছ খেয়েই মন ভরে গেছে। ইলিশ, পাবদা, পার্শে ছাড়াও কতরকমের যে মাছ ! সব মিলিয়ে, রোজকার থেকে একটু হলেও অন্যরকম একটা জীবন।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল। গত সন্ধ্যার সেই হুল্লোড় আজ নেই। একাকী বয়ে চলেছে ইছামতী। এই নির্জন
ইছামতীও (ichamati) অনেক কথা বলতে চায়। সেই নদীর গান শুনতে আবার ফিরে আসব। সেদিন যাব অন্যদের কাছেও।
মনে রাখবেন: শিয়ালদহ থেকে বসিরহাট লোকাল (basirhat local) প্রতিদিন ৪৫-৫০ মিনিট অন্তর ছাড়ে। এছাড়া আপনি সড়ক পথেও যেতে পারেন। নিজেদের গাড়ি থাকলে ভ্রমণের আনন্দই আলাদা। কিন্ত প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করলে খরচ বড় বেশি। এছাড়া ধর্মতলা (dharmatala) বাস স্ট্যান্ড থেকে বেসরকারী বাসেও যেতে পারেন। সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টার বেশি।
যে কোনও সময় যেতে পারেন। তবে শীতের আমজে ভ্রমণ সব থেকে ভাল। দু’একটা দিন খুবই ভাল লাগবে।
থাকার জন্য অনেক বেসিরকারী হোটেল ও লজ পাবেন। এছাড়া টাকি পুরসভার অতিথি নিবাসেও থাকতে পারেন ।
যোগাযোগঃ ৯৩৩১০ ২৬৫৮৫/ ৯৩৩৯৩ ৭৫৯১৫