হাতি মোড় থেকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে কিরিবুরু (kiriburu) হয়ে মেঘাতাবুরু (meghataburu) আর আরেকটা চলে গিয়েছে গুয়ার (gua) দিকে। খানিক দূরেই টিলার উপর বাংলোটা। দুধ রঙের বাংলোয় সবুজ ফেট্টি। পিচ রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়েই বাঁদিকে মোরামের চমৎকার ঘোরানো পথ পৌঁছে দেবে, বাংলোর হাতা। পথের দুপাশে ঘন বন। সামনে পেছনে মিলিয়ে বেশ মনোরম পরিবেশে সারেন্ডার বনাঞ্চলে (saranda forest) বরাইবুরু বনকুঠির। একতলা বাংলোয় দুটো ঘর।
কেয়ারটেকার বিক্রম জাগাতে, বয়সে প্রবীণ। জেরাইকেলা বাংলোয় থাকাকালীন শরীরের ডানদিক অবশ হয়ে যায়! তারপর থেকেই এই বাংলোয়। তার ছেলে জোসেফ পরচি চায়। বাবার হয়ে সব কাজ সেই করে এখন। আধুনিক আসবাবে সুসজ্জিত দুই ঘর। বাইরে সাবেকিয়ানার ছোঁয়া। লোহা বোঝাই ট্রাকের দল সারাদিন চলতে থাকে নিচের রাস্তা দিয়ে। সন্ধের শেষ ট্রাক চলে যাবার পর জায়গাটা নিশ্চুপ পড়ে থাকে নদীর কথা শুনবে বলে। বাংলোর ঠিক নিচ দিয়েই চলেছে কারো নদী। লোহা ধোয়া জলে তার রং লাল। ঝিঁঝিঁর কনসার্ট এর মাঝেই হঠাৎ কোটরার লাভ কল! বিক্রমজি বলে, “শাল বনে আজ এক অঙ্গীকার হবে, নতুন চাঁদের আলোয়”। “মানে?” হেসে বলে বর্ষীয়ান বনপুরুষ, “আট মাস পরে শাল তলে ভূমিষ্ট হবে হরিণশিশু! তাই চাঁদ সাক্ষী রেখে মাদা-মাদী আজ মিলিত হবে, যদি না লেপার্ড লাভ জেহাদ ঘোষণা করে। ভালোবাসার ডাক ক্রমশ দূরে সরে যায়। বনগন্ধী সন্ধ্যাসাঁঝে দিশাহারা হয় কাঙ্খিত প্রেম।
সাতশো পাহাড়ের দেশে (saranda forest region) ভোর। অরুন আলোর করুন দশা। মেঘ কুয়াশার ধোঁয়াশায় মমতার পরশ শাল পাতায়। জাগাতের বাড়ির মাথায় এক রামপাখি “কোঁকর-ক, কোঁকর-ক”। শাল বাতাসে হি হি ভাব। পাকদন্ডী বেয়ে একটা দ্বিচক্রযান এসে থামলো বাংলো হাতায়। সঞ্জিত মাহাতো বছর খানেক হলো এখানকার বিটবাবু। বয়সে নবীন। আলাপচারিতার সহজিয়া ভাব বিনিময়। “ঘুরে আসুন লোহা পাহাড়ের অন্দরে, অরণ্যের অন্তর জুড়ে আছে শ্বাপদের টানেল আর ধামসা -মাদলের আহ্বান”, “শুনেছি কিছু ভূত বাংলোও আছে?”, “ছিল, পোঙ্গা ও সালাইতে! এখন সে বাংলোও নেই ভূতও নেই”, বলে বিটবাবু হা -হা স্বরে হেসে ওঠেন।
“এই যে বাংলোতে আছেন, এরও তো হানাবাড়ি বলে পরিচয়! সাহেবরা ফুর্তি করতো এই সব বনকুঠিরে, সারারাত। যুবতী হো, সাঁওতালরাই তাদের ভোগ্য হতো। মদের সাথে হো যুবতী খুবলে খেত, দিকুগুলো।তারপর খুন করে কারোর জলে ভাসিয়ে দিতো। সেই সব “চিরকিন”-রাই ঘুরে বেড়ায় সারান্ডার বনে বাদাড়ে”। সকাল সকাল খুন খারাপির গল্প শুনে মনটা গেলো দম মেরে। হুপ হুপ শব্দে , হনুমান গাছ বদলি খেলায় মেতেছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, বিক্রমজি লাঠি হাতে “ঠুক ঠুক” শব্দে ধীরে ধীরে বাংলো লনে পায়চারি করছে আর বিষন্ন চোখে কারোর দিকে তাকাচ্ছে।
থলকোবাদের নতুন বাংলোটা বড্ডো বেশি আধুনিক! পুরোনো “ফিলিপ্স রেস্ট হাউস” টা অনেক বুনো ছিল। সেবার চার রাতের ভরপুর প্যাকেজ ছকা ছিল। এক রাত কুমডি, এক রাত লিগিরডা আর দুই রাত থলকোবাদ। আদি বাসস্থান-গুলোয় হান্ডিয়া-মহুয়ার বাঁধনে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। কদমাপাড়ার চূড়ামনির ঠেকে সারাদিন! চূড়ামনির ডাগর চাউনিতে এক বন্ধু বলেছিলো “আরো তিনদিনের এক্সটেনশন চাই জার্নিতে!” দিনগুলো সুখপ্রদ আর রাত্রি রমণীয়। আর সব ছাপিয়ে ডাকতো নিবিড় ঘন মায়ায়।
পাশের ভিউ পয়েন্টটার থেকে বনপাহাড়ের দৃশ্য নতুন বোধশক্তির উন্মেষ ঘটাতো। সন্ধেবেলা হাতির দল সামনের কাঁঠাল বাগানটার থেকে পট-পট করে কাঁঠাল সাবড়ে, দল ভেঙে চলে যেত গভীর বনে। তারপর সব চুপচাপ। “সার্গিয়া হোনানকা”, চুট্টা টেনে ফিলিপ্স সাহেব আর হো রমণীর প্রেম কাহানী শোনাতে শোনাতে “রসি” পানির ধকে বাংলো বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়তো। সার্গিয়া বছর দুই হলো মারা গিয়েছে ! তার ছেলে গোবিন্দ এখন নতুন বাংলোর দায়িত্বে।
বরাইবুরুর রান্নাঘরটা বাংলোর পেছনদিকে প্রায় সাত/আটটা সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। সেখানেই বিক্রম জাগাতে বসে ছিল। “আইয়ে সাব বৈঠিয়ে ইহা”। ধীর স্থির মানুষ জাগাতে বিগত দিনের হাজারো তথ্য দিয়ে জমিয়ে দিলো আড্ডাটা। মনে পড়ে সারান্ডার (saranda) দামাল ছিল যারা, মানে শক্তি, সুনীল, সন্দীপন, কমল চক্রবর্তী, জগন্নাথ ঘোষ, তাদের লেখায় ও কথায় এই বিক্রম জাগাতে ও সার্গিয়ার কথা বার বার এসেছে, এরা সারান্ডার (saranda) সেলিব্রিটি ছিল! আগে সারান্ডা (saranda) নিয়ে লেখা মানেই এই দুইজন নিয়মানুসারেই চলে আসতো। সারান্ডার (saranda) চলমান ইতিহাসের সামনে বসে ভাবি, যে সেই কবে থেকে ঋদ্ধ হয়েছে, হচ্ছে দিকূজন এই মানুষগুলোর দ্বারা।
জেরাইকেলা বনবাংলোর কথা বলতে বসে, জাগাতের চোখে জল আসে। সেদিন তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে অরণ্যের গভীরে ঢুকেছিলো “বনকান্দা (আলু)” আনবে বলে। পাখি ডাকা বনে শান্তির বাতাবরণ এর সাথে ঝিরি ঝিরি হাওয়া প্রলেপ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো। অতর্কিতে লাল বাহিনী তাদের ঘিরে ধরে। সটান নিয়ে চলে আসে বাংলো চত্বরে। তারপর তাদেরই চোখের সামনে বিপ্লবী স্লোগানের ধ্বনিতে উড়িয়ে দেয় বাংলোখানা! প্রাণে মারেনি বলে এখন তাদের “দোয়া” দেয় এই সাদাসিধে মানুষটা। চোখ বেঁধে দুইজনকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিলো অতি বিপ্লবীর দল। সে কথা মনে পড়লে মারাংবুরুকে ধন্যবাদ জানায় সে।
“স্যাডেল” বা “স্যাভেল” গেট থেকে কুমডি বাংলো প্রায় ১০ কি মি। ক্ষমাহীন জঙ্গলের স্ট্রেচ। মাঝে একটা বনগ্রাম। নিঝুমতার পরতে পড়ে আছে নিঃস্বার্থভাবে। পাশ কাটিয়ে খানিকটা এগোতেই “কোয়েনার” সঙ্গ। রাস্তার ডানদিক ঘেঁষে অবিরাম স্রোতের ধারা। কুমডির বাংলো গভীর অরণ্যের ঘেরাটোপে। এখানেও সেই একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি। বিপ্লবীদের রোষানলে পড়ে গোটা বাংলোটাই বেবাক হাওয়া।
কুমডি বড় সুন্দর বাংলো ছিল। লাল রঙের বন কুঠির আর চারপাশে সবুজের ব্রাশস্ট্রোক। দু কামরার স্বর্গ । পাশের কুঁয়োর জলে স্নান-খাওয়া আর বনভ্রমণ ছিল নিত্যদিনের কাজ। সেবার অনেক রাত, চৌকিদারহীন বাংলোয় আমরা পাঁচজন। দোল পূর্ণিমার চাঁদ ঝুলে আছে শাল বনে। অনেক ডাকাডাকিতেও মোহন সিং এর দেখা না পেয়ে পাশের গ্রামে হানা দিই। ভাল্লুককের ভয় আছে, হাতির ভয় আছে। মদ-মাদলের উৎসব শেষে গোটা গ্রামটা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। অগত্যা ঠিক হয় , বাংলো বারান্দায় রাত্রিবাস। পাশ দিয়েই চলেছে কোয়েনার আরণ্যক কাব্য, তার উপর ছোট কজওয়ে।
সেই কজওয়ে আজও আছে। কজওয়ের উপরেই বসে আমাদের রাতের হ্যাংআউট। মধ্যরাত অবধি সঙ্গ দেয় রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, বোদলেয়ার…। শেষ রাতে বাংলো বারান্দায় সঙ্গ দেয় সারান্ডার (saranda) কুখ্যাত মশার দল। কুমডি বনাঞ্চল আজও দারুন সুন্দর। রিমঝিম হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় বনফুল। কোয়না আজও অবিরাম, নিয়মনিষ্ঠ। লম্বা লম্বা শাল, মহুয়া, কুসুমের সাবেকি সংসার। কিছু চাষ-আবাদের জমি আর গ্রাম। গ্রামের অনেকেই লোহাপাহাড়ের লোহা-শ্রমিক। শান্ত, চাপহীন জীবন।
কুমডি থেকে পোঙ্গা (মারাংপোঙ্গা) যাবার রাস্তায় বেশ কয়েকটা হেয়ারপিন বাঁক আছে। পৃথিবীর সব থেকে বড় শালের জঙ্গলে মায়াবী ভোর। বাতাসে সুক্ষ সৌখিনতা। বনফুলের বিলাসী সৌরভে আত্মহারা মৌটুসী। শিশিরের ফিসফিসানি পাতা, ফুল, ঘাসে। এখাকার অরণ্য এমনি, বারমাসে। পোঙার দিকের জঙ্গল কিছুটা অন্যরকম। মাঝে মাঝেই আদিগন্ত ধানমাঠের শরীর চিরে আলপথ। দূরে পাহাড়শ্রেণী। বেনেবউ অরণ্য কোঠরে গেয়ে ওঠে গান আর ধানমাঠ পেরিয়ে ভেসে আসে নবান্নের ঘ্রান। একেবারে পথের পাশে, পোঙ্গা বনবাংলো।
পোঙ্গা বনবাংলো সব থেকে কুখ্যাত, ভূতবাংলো হিসাবে সমগ্র লোহাপাহাড়ের দেশে। বিশেষ করে এক মেম ভূত বেশ সাড়া ফেলেছিলো, ৬০/৭০ এর দশকে! তারপর সেই বিদেশিনী গিয়ে আসে এক অল্পবয়সী “হো” নারী। তার রাজ্ চলে এই সেদিন অবধি। এখন জরাজীর্ণ অবস্থা এই শতাব্দী প্রাচীন বনকুঠিরের। সাপের খোলস ভাঙা জানালার ফ্রেমে, গরু-মোষের গোবর সারা ঘরময়, পাঁচিল ভেঙে পড়েছে প্রায় সমগ্র বাংলোটার। পোঙার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটা ধরে এগোলে দুর্দান্ত এক জঙ্গল পাওয়া যায়। রাস্তার দুই পাশে সামান্য উঁচু জমি ক্রমশ উপরে উঠেছে। সেই ধাপ ধরে শালের ঘন বন। রাস্তাটা প্রায় কিমি দুয়েক একেবারে সোজা। মাঝে মাঝে সূর্যের বিম শালের শরীর ভেদ করে এদিকে-সেদিকে, আর দূরে-বহুদূরে ঢেউ খেলানো প্রান্তরের অতলান্ত সবুজের মাঝে, নীল চালের লাল বাড়ি। কে থাকে ওই একলা বাড়িতে? কোনো “চিরকিন নয়তো!
পোঙ্গা থেকে ফেরার পথে বিপত্তি! গাড়ি বিগড়িয়েছে ঘন বনের মাঝখানে। চালক বলে, “হাতি চড়া জঙ্গলেই খারাপ হলো ! মুঠোফোনের টাওয়ার পাওয়াই মুশকিল এখন থেকে। গ্যারেজ এখন থেকে প্রায় দুঘন্টার রাস্তা। দেখি কি করি”।
বুঝলাম ভালোমত ফেঁসেছি। অরণ্যে একধরণের পোকা থাকে, যেগুলো শুধু চোখের আশেপাশে বা চোখের ভিতরে যাবার প্রচেষ্টায় অবিচল সর্ব্বক্ষন। হো ভাষায় সেগুলোকে বলে, “পুতকি”। বড় বিরক্তিকর। তাদের উপদ্রপে হিমশিম অবস্থা। খানিক দূরে কাঁঠালের বন। তাতে আর ডাল নেই, শুধুই সর্বাঙ্গ জুড়ে ঝুলে আছে “হাতি-ফল”। দূর পাহাড়ের মাথায় কৃষ্ণ মেঘের সমারোহ। ধূসর মেঘের ব্যাকড্রপে নানান শেডের সবুজ ধাপে ধাপে! নৈসর্গিক দৃশ্য। এলোমেলো ঘোরাঘুরি ছাড়া কোনো কাজ নেই। এরই মধ্যে কজওয়ের উপর দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর অমোঘ বাণী, “টাওয়ার আসছে এখান থেকে!” ঘন্টা তিনেক বাদে কমলের হাতযশে আবার লাফ সফর শুরু।
করমপদার হাট একসময় বিখ্যাত ছিল হান্ডিয়া-মহুয়ার ঠেকের জন্য। গভীর জঙ্গল এখানে। সেখানে মাত্র ১০ টাকায় এক বোতল হান্ডিয়া, সাথে ছোলা-মোটররের চাট যেন অমৃত সমান! রাস্তার পাশে কোয়েনার উপর কজওয়ে, সেখানেই দুইজন কুঁচো মাছের আশায় ফাৎনা ফেলেছে। করমপদা হাটের বিশেষ আকর্ষণ আজও হান্ডিয়া-মহুয়ার দেদার বিকিকিনি ও মোরগের জবরদস্ত লড়াই। সেই লড়াই দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোকে ভিড় করে।
এই হাট শালবনের আড়ালে বসে। বেশ খানিকটা খোলা চত্বর, তার চারপাশে শালের গঠনপ্রকৃতি। কুমডি বাংলো থেকে ১৮ কি মি দূরে এই হাটের অবস্থান। হাঁড়ি, কলসি, চাটাই, নানারকমের তীর, কুলো, সস্তা প্রসাধনী সামগ্রী…. আরো কত কিসিমের হাতছানি নিয়ে হাজির এই বনজ হাট। সরল, সাবলীল গ্রামবাসীর মিলনক্ষেত্র। রকমারি মাতাল দেখারও শ্রেষ্ঠ জায়গা এইসব হাটগুলো।
করমপদা থেকে জঙ্গলে জঙ্গলে কিরিবুরুর রাস্তা প্রায় ১৫ কিমি। পুরো রাস্তাটাই কাঁচা পথের। হঠাৎ এক জায়গায় সেই পথ দুই ভাগ হয়েছে। বাঁদিকের পথের সামনে শুকনো শালপাতার তোরণ তৈরী করা। তাতে লাল শালু ঝুলছে। বুঝতে পারি “রেড-করিডোরের” মধ্যে দিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। ডানদিকের রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা এগোলেই লৌহ শহর মেঘাতাবুরুর পাকা রাস্তা পাওয়া যায়। মেঘাতাবুরু ধৌতগারের তলা দিয়ে সেই রাস্তা। ৫ কিমি ঘন বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে চলার পরে কিরিবুরুর (kiriburu) শহর চোখে পড়ে।
হো ভাষায় “বুরু” কথার অর্থ “জঙ্গল”। “কিরি” কথার অর্থ “পোকা”, অর্থাৎ “পোকার জঙ্গল” হলো কিরিবুরু। আর তার পাশেই শৈলশহর “মেঘাতাবুরু”। মানে “মেঘের জঙ্গল”। আবার অন্য অর্থও আছে “বুরু” কথার ! “ছোট পাহাড়” বা “টিলা”। অর্থাৎ “পোকার পাহাড়” ও “মেঘের পাহাড়”, কিরিবুরু ও মেঘাতাবুরু। পাহাড়ি অরণ্যের মধ্যে একসময়ের গ্রাম দুটি স্টিল অথরিটির কল্যানে পরবর্তীকালে শহরের সাজ পেয়েছে। লৌহ আকরের প্রাচুর্যে দুটি শহরই এখন মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। এখানকার নৈসর্গ অনবদ্য! সূর্যাস্তের সময় সব চেয়ে সুন্দর। সমগ্র সারান্ডা বনাঞ্চল পাখির চোখে দেখা যায় এখন থেকে। সাতশো পাহাড়ের রুপটান। ক্রমে দিন শেষ হয়। পশ্চিমের অরণ্যে মিলিয়ে যায় সূর্যের লালাভ রেখা।
আজ শেষ রাত। বরাইবুরু বাংলোয় হামলে পড়ে চাঁদ। তার ডেয়ারি ছলকে পড়ে বাংলো কার্নিশে, বৃক্ষ শরীরে, চিকন ঘাসেতে। বসেছি বাংলো বারান্দায়। দূরে শো শো শব্দ। বনপাহাড় পেরিয়ে যেন কোন অশ্বরোহীর উসৃঙ্খল ঐকতান। ক্রমশ এগিয়ে আসে সেই দূরবর্তী কোলাহল। সে এক অদ্ভুত হাওয়া! শালের সংসারে দোলা লাগিয়ে ঘুরতে থাকে চক্রাকারে। শুধু মাথায় মাথায় তার বিচরণ।
জাগাতে বলে, “ঘরে চলুন খানিকক্ষণ”। “কি ব্যাপার বিক্রমজি?”, “বনে অনেক রকমের হাওয়া বা বাতাস ঘোরে। যার কোনটা কোনটা ভালো আর বেশিরভাগই খারাপ! দেখলেন না, কেমন গাছেদের ঝুটি নাড়িয়ে চলে গেল “। সত্যি বেবাক হাওয়া সেই বাতাস। কাছেই “কোটরা” টা আবার ডেকে ওঠে। ইস্পাত জোৎস্নায় পেঁচা উড়ে যায়। খাপু পাখি “খাপু-খাপু-খাপু” শব্দতরঙ্গ ছড়িয়ে দেয় নিকট হতে দূরে আরো দূর-জঙ্গলে। রহস্যের দূতেরা জানায় তাদের বার্তা সারান্ডার (হাতি) (saranda) নিবিড় বনাঞ্চলে। সেই বার্তার হুশিয়ারিতে জেগে থাকে গ্রাম, নদী, জঙ্গলের ছায়া-উপছায়ারা। তরল মহুয়ার গরল নেশায় দেখি শাল জঙ্গলের অবগুন্ঠনে কারোর জলে উর্ধবাহু এক জিনপরি চাঁদকে আহ্বান জানাচ্ছে মর্তে আসার।