অনেকবার পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিয়েছি। বলা ভাল, মাঝে মাঝেই মনটা কেমন পাহাড় পাহাড় করে। গড়পড়তা বাঙালির একটা অদ্ভুত ব্যামো আছে। সে পাহাড় বলতেই বোঝে দার্জিলিং। আর সিকিম হলে গ্যাংটক। আরে বাবা, এর বাইরেও যে একটা বিরাট পাহাড় পড়ে আছে, সেটা কে বোঝায়! এনজেপি–তে নামুন। দার্জিলিং–দার্জিলিং আর গ্যাংটক–গ্যাংটক চিৎকার শুনে আপনার কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। যেন তার বাইরে কোনও জায়গাই নেই। কার্শিয়াং (kurseong) বা কালিম্পংকে (kalimpong) ঘিরে আশেপাশে কত ভাল ভাল জায়গা। সেখানে গড়পড়তা টুরিস্ট গেলই না। সে দার্জিলিং নিয়েই মেতে রইল।
কয়েকমাস আগের কথা। তখনও করোনা বা লকডাউন নামক শব্দগুলো বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে ঢুকে পড়েনি। কোথায় যাই, কোথায় যাই? নানা আলোচনা হল বটে। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই পাহাড়। এবারও সেই একই ফর্মুলা। আগে এনজেপি পর্যন্ত টিকিট তো কেটে রাখা যাক। বাকিটা না হয় পরে ভাবা যাবে।
কালিম্পং (kalimpong) শহরটা কোনওবারেই তেমন ভাল লাগেনি। বড্ড ঘিঞ্জি। আশেপাশে অনেক ভাল জায়গা আছে। সেসব জায়গায় গিয়েছি, থেকেওছি। কিন্তু শহরটায় এলেই যেন একরাশ বিরক্তি। কিন্তু এবার আমাদের ঠিকানা হল সেই কালিম্পং (kalimpong)। তবে শহরের ভিড় বা যানজট থেকে একটু অন্যদিকে, মর্গান হাউসে (morgan house)।
ভূত বাংলো (haunted house) হিসেবে পরিচিতি আছে। গুগলে গিয়ে হন্টেড হাউস সার্চ করলে একেবারে শুরুর দিকেই এই বাংলোটার (morgan house) কথা পাবেন। নানা গল্প ছড়িয়ে আছে। যার অধিকাংশরই কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। কিন্তু লোকমুখে এমন কত লোকগাথা ছড়িয়ে যায়। গল্পের ডালপালা আর কবে যুক্তি–বুদ্ধির সরণি বেয়ে হেঁটেছে! তবে ভয়ের কোনও কারণ নেই। দুই রাতে আমরা অন্তত কোনও সাহেব ভূত বা বাঙালি ভূতের দেখা পাইনি। অবশ্য মাঝরাতে বাংলোর লনে ঘুরে বেড়ানোর দুঃসাহসও দেখাইনি। কারণ, কোনও অ্যাডভেঞ্চার করতেও যাইনি, ভূতের ইন্টারভিউ নিতেও যাইনি। গিয়েছিলাম নিখাদ বেড়াতে। ফলে, দুঃসাহসটা কোয়ারেন্টিনে রেখেই গিয়েছিলাম।
সাহেবি আমলের বাংলো। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিল। এখন অবশ্য পর্যটন দপ্তরের অধীন। কলকাতা থেকে বুকিং করা যায়। অনলাইনেও বুকিং করা যায়। কোন কোন সেলিব্রিটি এসেছেন, সেই তালিকা করতে গেলে অনায়াসেই সেঞ্চুরি ছাপিয়ে যাবে। অনেকের কাছেই মর্গান হাউসের (morgan house) কথা শুনেছি। পরে ইউটিউবেও কিঞ্চিৎ চর্চা হল। মনে হল, যাওয়া যেতেই পারে। বুকিংও পাওয়া গেল। তবে দুদিনের। এনজেপি থেকে সরাসরি গাড়ি নেওয়া যায়। খরচ বাঁচাতে চাইলে, কালিম্পং (kalimpong) স্ট্যান্ডে এসে সেখান থেকে একটা লোকাল ট্যাক্সি নিতে পারেন।
অনেক ভুল ধারণা ভেঙে গেল। যে কালিম্পংকে (kalimpong) কিছুটা তাচ্ছিল্য করতাম, সেই কালিম্পং যেন নিজেকে অন্য চেহারায় ধরা দিল। এই কালিম্পংকে আগে তো কখনও দেখিনি। ঢুকতেই বিশাল এক লন। এখানে বসে শীতের রোদ গায়ে মেখেই অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। লনে চেয়ার, টেবিল পাতা। অর্থাৎ গা এলিয়ে আড্ডা দেওয়ার পটভূমি তৈরি করাই আছে। এছাড়াও নানা প্রান্তে পার্মানেন্ট বেঞ্চ লাগানো আছে।
একেবারেই সাহেবি বাংলো। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে পোড়ো বাড়ি। আসলে, ভেতরটা ঝাঁ চকচকে করলেও বাইরের চেহারাটা ইচ্ছে করেই বদলানোর চেষ্টা হয়নি। বলা ভাল, উন্নয়নের নামে অহেতুক পাকামি করা হয়নি। কর্পোরেট আদল আনতে গেলে সাবেকিয়ানাটাই হারিয়ে যেত।
ভেতরের সিঁড়ি থেকে মেঝে, সবই কাঠের। ফলে, অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ। আর ঘরটার তো তুলনা নেই। ছোটখাটো একটা ফুটবল মাঠ বলতে পারেন। অথচ, ভাড়া যে খুব বেশি, তাও নয়। দার্জিলিংয়ের (darjeeling) বিভিন্ন ঘিঞ্জি হোটেলগুলোর ভাড়া আড়াই–তিন হাজার। অথচ, এখানে ১৮০০ বা ২১০০ টাকার ঘরগুলো যেন রাজকীয়। জানালার পর্দা সরালেই ধরা দেবে পাহাড়ের নানা চূড়া। মেঘ এসে ঢুকে পড়বে জানালা দিয়ে। পাশেই ছাদে গেলে ধরা দেবে পাহাড়ের অন্য দিকগুলো। টুরিস্টের আনাগোনা ভালই। ফলে, সাবেবি বাংলার লাগোয়া এলাকায় কিছু অ্যানেক্স কটেজ তৈরি হয়েছে। ঝাঁ চকচকে, অত্যাধুনিক। তবে, থাকতে হলে আদি মর্গান হাউসে (morgan house) থাকাই ভাল।
ভেতরের সিঁড়ি থেকে মেঝে, সবই কাঠের। ফলে, অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ। আর ঘরটার তো তুলনা নেই। ছোটখাটো একটা ফুটবল মাঠ বলতে পারেন। অথচ, ভাড়া যে খুব বেশি, তাও নয়। দার্জিলিংয়ের (darjeeling) বিভিন্ন ঘিঞ্জি হোটেলগুলোর ভাড়া আড়াই–তিন হাজার। অথচ, এখানে ১৮০০ বা ২১০০ টাকার ঘরগুলো যেন রাজকীয়। জানালার পর্দা সরালেই ধরা দেবে পাহাড়ের নানা চূড়া। মেঘ এসে ঢুকে পড়বে জানালা দিয়ে। পাশেই ছাদে গেলে ধরা দেবে পাহাড়ের অন্য দিকগুলো। টুরিস্টের আনাগোনা ভালই। ফলে, সাবেবি বাংলার লাগোয়া এলাকায় কিছু অ্যানেক্স কটেজ তৈরি হয়েছে। ঝাঁ চকচকে, অত্যাধুনিক। তবে, থাকতে হলে আদি মর্গান হাউসে (morgan house) থাকাই ভাল।
একটু বাইরে টহল দেওয়া যাক। এই এলাকাটা কিন্তু সেনাবাহিনী এলাকার মধ্যে পড়ে। ফলে অকারণ যানজট নেই। কাছ থেকে সেনা ব্যারাক দেখার সুযোগ কজনের আর হয়! বাইরে বেরোলেই চোখে পড়বে বিরাট এক গল্ফ কোর্স। এটাও সাহেবদের বানানো। এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কত ছবির শুটিং যে হয়েছে, তার ইয়াত্তা নেই। আপনার কোনও একটা চেনা ছবির কথা নিশ্চিতভাবেই মনে পড়ে যাবে। সেনাবাহিনীর একটা সুন্দর সাজানো ক্যান্টিন। সেখানে এটা–সেটা খেতে খেতে তাকিয়ে থাকুন ওই দিগন্ত বিস্তৃত গল্ফ কোর্সের দিকে। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধের দিকে। সে এক চোখজুড়োনো ক্যানভাস।
পরেরদিন সাতসকালে বেরিয়ে পড়ুন। হেঁটে হেঁটে যেখানে খুশি। আর্মি এলাকার ভেতর দিয়েই আপনি হেঁটে চলেছেন। তবে, তেমন কড়াকড়ি নেই। প্রশ্নবানের মুখেও পড়তে হবে না। গাড়ি নিয়ে ঘুরলে হয়ত টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে পারেন। কিন্তু পায়ে হেঁটে ঘুরলে কেউই জেরা করবে না। সেনা জওয়ানদের জীবনযাত্রা এত কাছ থেকে দেখার সুযোগটা হল বাড়তি পাওনা।
সামনেই একটা চৌমাথা। একেক দিকে একেকটা রাস্তা চলে যাচ্ছে। যেটা খুশি ধরে ফেলুন। একের রাস্তার একেক রকম দৃশ্য। একটা রাস্তা চলে গেছে গুম্ফার দিকে। গুম্ফা থেকেই না হয় ঘুরে আসুন। দূর থেকে খুদে সন্ন্যাসীদের কান্ডকারখানা দেখে যান। এক অনাবিল আনন্দ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। চাইলে, ওদের সঙ্গে টুকটাক আড্ডাও দিতে পারেন। মন্দ লাগবে না।
ফাঁকা রাস্তা ধরে কিছুদূর নেমে যান। বাঁকের মুখে একটা ভিউ পয়েন্ট। সেখানে দুদণ্ড সময় কাটাতে পারেন। হাঁটতে পারলে তো ভালই। না পারলেও চিন্তা নেই। সেনাবাহিনীর অনেক গাড়ি ওপরে উঠছে। হাত দেখিয়ে টুরিস্ট পরিচয় দিলে ওঁরা ঠিক মর্গান হাউসের (morgan house) মুখে ছেড়ে দেবেন। অন্তত আমাদের কোনও সমস্যা হয়নি। ফিরে এসে আবার ওই কফি শপে একটু আড্ডা দিন। বিকেলে আবার কোনও একটা রাস্তা বেছে নিন। কোথাও সূর্যোদয়, কোথাও সূর্যাস্ত। মোদ্দা কথা, অহেতুক ব্যস্ততা নয়। আপন মনে হেঁটে বেড়ান। প্রতিটি মুহূর্ত নিজের মতো করে উপভোগ করুন।