প্রেমটা কুমিল্লার এক ছেলের সাথে হয়েছিল। সে কি প্রেম! পারলে তাকে কোলে নিয়ে একটু নাচানাচি করে নেই। কিন্তু তা টিকলো না। কোনো এক কবি বলেছিলেন “যাকে ভালবাসি, তার আসে পাশের সব কিছুই ভালবাসি” আমার ব্যাপারটা এমনি অনেকটা। আমি তাকে ঘৃণা করি, তার আসে পাশে সব কিছুই ঘৃণা করি! তাই ছোট ভাই যখন বলল আপু চল ময়নামতি (mainamati) ঘুরে আসি আমি এক বাক্যে না করে দিলাম।
কিন্তু সে নাছোড় বান্দা পাশে বসে বসে ঘ্যান ঘ্যান করা শুরু করল। আমি রেগে বললাম কি এমন আছে ওই জায়গায়, কেন যেতে চাচ্ছিস? কিছু জানিস ওর ব্যাপারে! ও তখন এক লাফে উঠে বসল আর বলতে শুরু করলো, তুমি জানো এযাবৎ আবিষ্কৃত লালমাই অঞ্চলের প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন হল ময়নামতি (mainamati) প্রত্নস্থল। বর্তমানে ময়নামতি (mainamati) অঞ্চলে যে ধ্বংসস্তূপ দেখা যায় তা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাচীন নগরী ও বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে ইহা জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
আমি খুব বিরক্ত হয়ে বললাম, “আচ্ছা, তারপর?”
ও বলে চললো, “ধারণা করা হয় যে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন আবার এর নামকরণে অন্য কিছু শোনা যায়। সেখানকার স্থানীয় লোকজন মনে করেন, সেই সমতট শাসনামলে রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিল রাজা মানিক চন্দ্র। ময়নামতি ছিল চন্দ্রবংশের রাজা মানিক চাঁদের স্ত্রী। ঐতিহাসিকদের মতে, রাণী ময়নামতির নামানুসারে এই অনুচ্চ পাহাড়ি এলাকার নাম রাখা হয় ময়নামতি (mainamati)।
১২ শতকে হিন্দু সেন রাজবংশের উত্থান এবং ১৩ শতকে মুসলিম অভিযানের পর থেকে নিরাপত্তার অভাবে ময়নামতির (mainamati) জনগণ এলাকা ছাড়তে থাকে, এমনকি দেশ ত্যাগ করে আরাকান, কামরূপ, তিব্বত, নেপাল, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চলের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। এভাবে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যেই ময়নামতি রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। অযত্ন অবহেলায় বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় স্থাপনাগুলো এক সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। কালে ক্রমে এই সমৃদ্ধ জনপদ লুপ্ত হয়ে মাটি চাপা পড়ে পরিণত হয় বন-জঙ্গলে।”
তো এসব দেখতে যাওয়ার কি আছে! আমি “যাবো না” বলে মাথার উপর বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম । “ঘুমতে দে যাহ …”
“আচ্ছা পুরোটা শুনবে তো, কুমিল্লার ময়নামতিতে (mainamati, comilla) খননকৃত সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার (shalban vihara) অন্যতম প্রধান। শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চার দিকের বেষ্টনী দেয়াল পিঠ করে নির্মিত। বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ। এ পথ বা দরজাটি উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝামাঝি স্খানে। প্রতিটি কক্ষের মাঝে ১.৫ মিটার চওড়া দেয়াল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রোঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে।”
তাই নাকি! এই যুগেও তামা, সোনার মুদ্রা দেখা সম্ভব!
“তাহলে আর বলছি কি। জাদুঘরে সবই সংরক্ষিত আছে। পুরা-বস্তু সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য ১৯৬৫ সালে কুমিল্লা (comilla) কোটবাড়ির শালবন বিহারের (shalban vihara) দক্ষিণ পাশে শালবনকে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। জাদুঘরে প্রদর্শনের উল্লেখযোগ্য পাথর ও ব্রোঞ্জ-মূর্তি হচ্ছে- বিভিন্ন ধরনের পাথরের দণ্ডায়মান লোকোত্তর বুদ্ধ মূর্তি, ত্রি বিক্রম বিষ্ণুমূর্তি, তারা মূর্তি, মারীছী মূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, পার্বতী মূর্তি, হরগৌরীমূর্তি, নন্দী মূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, মনসা মূর্তি, গণেশ মূর্তি, সূর্য-মূর্তি, হেরুক মূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ্রসত্ত্ব মূর্তি।
এছাড়াও ব্রোঞ্জের ছোট-বড় আরও মূর্তি রয়েছে। এ জাদুঘরে রয়েছে ব্রোঞ্জের তৈরী বিশালাকায় একটি ঘন্টা। যার ওজন ৫শ’ কেজি। এর ব্যাস ০.৮৪ মিটার এর উপরের বেড়িসহ উচ্চতা ০.৭৪ মিটার। তুলট কাগজে লেখা প্রাচীন হস্তলিপির পাণ্ডুলিপি। বিভিন্ন নমুনার মৃৎপাত্র।
ঢাকা থেকে ১১৪ কি.মি. দূরে ময়নামতির অবস্থান এবং চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ২ ঘন্টায় ময়নামতি পৌঁছানো সম্ভব । প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের আনাগোনা হয়। যাবা আপু?”
তাহলে তো একবার যাওয়া যায়। আমার ভাই এক লাফে উঠে বলল, “১০ মিনিটের মধ্যে রেডি হও আমি গাড়ি বের করতে বলছি!”