ডিসেম্বর মাস। সব পরীক্ষা শেষ। দুইদিন আগেই মাত্র ঘুরে এলাম সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে। তবুও কেন যেন কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য মন আনচান করতে লাগলো। সাত পাঁচ না ভেবেই আরো কয়েকজন সাথে নিয়ে উঠে বসলাম খাগড়াছড়ির বাসে।
ভোররাতে ভয়ানক রকমের বাসের দুলুনিতে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি পাহাড়ের গা বেঁয়ে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে আমাদের বাস এগিয়ে চলেছে খাগড়াছড়ির দিকে। সেই সময় কারো চোখে আর ঘুম নেই, সবাই চোখ মেলে ড্যাবড্যাব করে এই উঁচু আর সরু রাস্তার সাথে আমাদের বাসের যুদ্ধ দেখতে লাগল। কখন যে এর মাঝে খাগড়াছড়ি চলে এলাম তা কে জানে?
সাজেকে যেতে হলে প্রথমেই খাগড়াছড়ি শহর থেকে চান্দের গাড়ি ভাড়া করতে হয়। ব্যস্ত মৌসুম থাকায় আমরা কোনরকম ঝুঁকি না নিয়ে ঢাকা থেকে বাসে ওঠার আগেই এক চান্দের গাড়ির ড্রাইভার ভাইয়ের সাথে ফোনে দরদাম করে রেখেছিলাম। ভাই চমৎকার একজন মানুষ! আমাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে প্রথমেই নিয়ে গেলেন একটা ছোট খাওয়ার হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া শেষে আমরা চেপে বসলাম আমাদের চান্দের গাড়িতে।
চান্দের গাড়ি হলো আসলে একরকমের মোডিফায়েড জিপগাড়ি যেটাকে স্থানীয় লোকেরা একটুআধটু ইঞ্জিনিয়ারিং করে দশ বারোজন বসার জায়গা বানিয়ে ফেলে। বহু আগে নাকি একবার সরকারের বড় এক কর্মকর্তা এই গাড়িতে চড়ে বলেছিলেন এই গাড়ি শুধু পাহাড় না, একেবারে চাঁদ পর্যন্ত চলে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে! সেই থেকেই এর নাম হয় চান্দের গাড়ি।
খাগড়াছড়ি থেকে রওনা দিলেও সাজেকের অবস্থান আসলে রাঙামাটি জেলার মধ্যে। সারাদিনে সকাল ও বিকাল মিলিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শুধুমাত্র দুইটি এস্কর্ট খাগড়াছড়ি থেকে সাজেক যায় আর আসে। ট্যুরিস্ট বহনকারী সব চান্দের গাড়িকেও সেই এস্কর্টের সাথেই সাজেকে যাওয়া আসা করতে হয়, এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটার কোনই সুযোগ নেই। পাহাড়ের সাপের মতন আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু রাস্তার এই লোম দাঁড় করানো যাত্রাটি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। পুরো রাস্তার প্রতি বাঁকে বাঁকেই যেন জড়িয়ে আছে প্রচুর অ্যাডভেঞ্চার। সাজেকের অন্যতম আনন্দ কিন্তু এই চান্দের গাড়িতেই!
সাজেকে পৌছে আমরা আমাদের কটেজে ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে নেই। বিশ্রাম নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয় কংলাক পাহাড়ের দিকে। কংলাক পাহাড় সাজেকের সবচাইতে উঁচু জায়গা যেখানে সবাই ভিড় করে সূর্যাস্ত দেখার জন্য। আকাশ ভরা সব মেঘেরা আমাদের চাইতে নিচে। তার মধ্যে দিয়ে শেষ বিকেলের রক্তিম সূর্যটাকে এত সুন্দর লাগছিল! সবাই দুচোখ ভরে তা দেখতে দেখতে পাহাড় বেঁয়ে আবার সাজেক ভ্যালিতে নেমে এলাম। পছন্দের মানুষদের সাথে সুখ দুঃখের কথা ভাগাভাগি করে সময় পার করার জন্য সন্ধ্যার পরের সময়টার কোনই তুলনা নেই। অনেকে আবার দেখি ফানুস উড়ালো। ছোট্ট হতে হতে সেই বিন্দুর মত ফানুস শেষমেশ হারিয়ে গেল আকাশের গহীনে।
সাজেকে বাঁশের বানানো কাপে করে চা খেতে পাওয়া যায়। স্বাদে অতটা ভাল না হলেও বাঁশের কাপের নেশায় প্রায় সবাই অন্তত একবার চা না খেয়ে ফেরেনা। রাতের খাবারের জন্য অবশ্যই টেস্ট করা দরকার ব্যাম্বু চিকেন। বাঁশের মধ্যে মুরগির মাংস মশলার সাথে মিশিয়ে পুরে দেয়া হয়। এরপর গরম ভাপে সেই বাঁশের মধ্যেই রান্না হয়ে অতুলনীয় স্বাদের ব্যাম্বু চিকেন। চাইলে চিকেন বারবিকিউ দিয়েও পার করে দিতে পারেন রাতটি।
পরদিন খুব ভোরে আমরা ঘুম থেকে উঠে শীতের জামা পরে তৈরি হয়ে নেই। দৌড়োতে থাকি সাজেকের হেলিপ্যাডের দিকে। এই জায়গাটি সাজেক থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য খুবই চমৎকার। সবাই মনের সুখ মিটিয়ে ছবি তুলে নেয়। আর এরই মাঝে উঠে যায় নতুন এক সকালের সূর্য। যতদূর চোখ যায় সব সবুজ আর সবুজ, আর তার উপরে মেঘের খেলা, মেঘের উপরে আমি। অসামান্য এক ভাল লাগার রেশ না কাটতেই আমাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে যায়। ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে আবার চান্দের গাড়িতে চড়ে বসি আমরা।
ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে বেশ কিছু বাস খাগড়াছড়ি আসে। সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে করে আপনাকে সাজেক আসতে হবে। থাকার জন্য নানান ধরনের কটেজের খোঁজ পাওয়া সম্ভব। তবে ছুটিছাটার সময় আগে থেকেই কটেজ ও চান্দের গাড়ির খোঁজ নিয়ে রাখা উত্তম। সাজেকের সাথে অনেকেই খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহা, রিসাং ঝর্ণা, হাজাছড়া ঝর্ণা ও খাগড়াছড়ি পার্কটি ঘুরে আসে। সময় স্বল্পতা না থাকলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন। মেঘের ভেলায় ভাসতে থাকা সাজেক ভ্যালি আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য!