বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁতে (Sonargaon, Naranganj) অবস্থিত পানাম নগর (panam city) কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ানো প্রায় পাঁচশো বছর পুরনো এক নগরী। সকলের কাছে “হারানো নগরী” (lost city) নামে অভিহিত হওয়া এই পানাম নগর (panam city) সোনারগাঁয়ের (sonargaon) প্রায় ২০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।
২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড (world monument fund) বিশ্বের প্রায় ধ্বংসের সম্মুখীন ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার যেই তালিকা প্রকাশ করে তাতে স্থান পায় নারায়ণগঞ্জের এই পানাম নগরী (panam city)।
পনেরো শতকে সোনারগাঁয়ে (sonargaon) প্রথম বাংলার রাজধানী (first captial of Bengal) স্থাপন করেছিলেন ঈসা খাঁ। ভৌগোলিকভাবে বেশ সুবিধাজনক স্থানে থাকাতেই মূলত এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক আধিপত্য এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পানাম নগরীর স্থাপত্যশৈলির মাঝে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণা লক্ষ করা যায়। ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতির এক অনন্য উদাহরণ হলো এই পানাম নগরী। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে যখন মুঘলরা সোনারগাঁ দখল করে নেয় তখন যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম করার জন্য তারা সড়ক ও সেতু নির্মাণ করে রাজধানীর সাথে পানামের (panam city) সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে।
মধ্যযুগে সোনারগাঁ বাংলার রাজধানী হওয়ার পর পানাম নগরীর ব্যাপক উন্নতি লক্ষ করা যায়। তবে বৃটিশরা এই এলাকার ক্ষমতা নিয়ে নিলে ক্রমেই এখানে হিন্দু ব্যবসায়ীদের একটি কতৃত্ব গড়ে ওঠে। পানামের বর্তমান সময়ে দেখতে পাওয়া বাড়িগুলো আসলে বৃটিশদের সহায়তায় ওই হিন্দু ব্যবসায়ীদেরই গড়ে তোলা। বৃটিশরা চলে যাওয়ার পর থেকে হিন্দুদের আধিপত্য ক্রমেই এখানে ফিকে হতে শুরু করে। এর ফলে ভবনগুলো প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় চলে যায়। আশেপাশের এলাকার লোকেরা তখন এই বাড়িগুলো দখল করে নেয় এবং এই দখলদারিত্ব বহুকাল পর্যন্ত বজায় ছিল। অবশেষে ২০০৯ সালে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে পানাম নগরীকে সম্পূর্ণরূপে দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়। পূর্বে পানাম নগরীর (panam city) ভবনগুলো ইজারা দেওয়া হলেও বর্তমানে আর এ ধরণের কিছু দেখা যায় না।
পানাম নগরীতে (panam city) যেসব অবকাঠামো এখনো টিকে আছে তার মাঝে ৫২টি বাড়িই বলা যায় উল্লেখযোগ্য। পানাম সড়কের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে যথাক্রমে ৩১টি ও ২১টি বাড়ি রয়েছে। বাড়িগুলোর বেশিরভাগই একতলা থেকে তিনতলা এবং আকারে আয়তক্ষেত্রের মতন। বাড়িগুলোর স্থাপত্যকলায় ঔপনিবেশিক ছোঁয়ার সাথে মুঘল, গ্রিক ও গান্ধারা স্থাপত্যশৈলিরও আলামত মেলে।
সবগুলো বাড়িই সুন্দর করে কারুকাজ করা এবং নির্মাণকৌশল্যের উদ্ভাবনী শক্তিতে ভরপুর। কিছু বাড়ির মেঝেতে ছিল লাল, সাদা ও কালো মোজাইকের সুক্ষ্ম কারুকাজ। বহু বিশেষজ্ঞ এসব কারুকাজকে ইউরোপের কাজের সাথে তুলনা করেছেন। সেই আমলে বাংলার মত একটি জায়গায় এত চমৎকার স্থাপত্যকৌশলের পরিচয় দেখতে পেয়ে মানুষ যারপরনাই বিস্মিত হয়ে থাকে।
পানাম নগরীকে (panam city) বলা যায় ঢেলে সাজানো হয়েছিল। এই নগরীর পরিকল্পনা ছিল একদম নিখুঁত। পানি সরবরাহের জন্য নগরীর দুইপাশে দুইটি খাল ও পাঁচটি পুকুর ছিল। এছাড়া প্রায় প্রতি বাড়িতেই ছিল কূপ বা কুয়া। নগরীতে যেন কখনোই জলাবদ্ধতার মত ব্যাপার না ঘটে এজন্য শহরটি খালগুলোর দিকে খানিকটা ঢালু। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্বও বেশ চমকপ্রদ। নগরীর যাতায়াতের জন্য তৈরি করা একমাত্র রাস্তাটি মাঝখানে দিয়ে চলে গিয়েছে একদম শেষ পর্যন্ত।
ঢাকা (Dhaka) থেকে অদূরে হওয়াই প্রচুর মানুষ এখনো এই প্রাচীন ও ধ্বংসপ্রায় নগরীতে দেখতে সোনারগাঁতে (sonargaon) ভিড় জমায়। নগরীর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যেন সবাই ফিরে যায় সেই পাঁচশো বছর আগের কোন এক সময়ে। খুঁজে ফেরে এই নগরীর হারানো দিনের সেই অতীত। ফিরে পেতে চায় পুরনো সেই উচ্ছ্বাস ও কোলাহল।
নারায়ণগঞ্জের পানাম নগরীতে (panam city) যেতে হলে প্রথমে ঢাকার গুলিস্তান (gulistan, Dhaka) থেকে বাসে উঠতে হবে। এসি ও নন এসি দুইরকমের বাসই পাওয়া যায়। বাস থেকে নামতে হবে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায়। সেখান থেকে রিকশা কিংবা অটোতে চড়ে বসলে অল্প সময়েই পৌঁছে যাবেন পানাম নগরীতে (panam city)। সোনারগাঁতে এখন লোকশিল্প জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। চাইলে ঘুরে আসতে পারেন এ জাদুঘরটিও। পুরনো আমলের এই ধ্বংসপ্রায় পানাম নগরী আপনার স্মৃতিকে নাড়া দেবে সহজেই!
ভালো লেগেছে!