প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন

on St. Martin Island, Bangladesh

on St. Martin Island, Bangladesh

ছয়টা মাস ভার্সিটির সিমেস্টারের চাপ নিয়ে আমরা তখন সবাই অত্যন্ত ক্লান্ত। যেই কয়জন মিলে আমরা হোস্টেলে থাকি তারা সবাই মিলে ঠিক করলাম পরীক্ষা শেষে এবার আর কোথাও না বেরুলেই নয়। আস্তে আস্তে দিন ঘনিয়ে এলো, আমাদের আকাঙ্ক্ষিত ছুটি চলে এলো। আমরা সবাই মিলে রওনা হয়ে গেলাম বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে। 

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পৌঁছুতে হলে প্রথমেই যেতে হয় বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের অন্তর্গত টেকনাফে। এখানে বাস থেকে নেমে উঠতে হবে সেন্ট মার্টিনগামী জাহাজে। প্রতিদিন সকাল নয়টার দিকে এখান থেকে বেশ কয়েকটা জাহাজ ছেড়ে যায়। যেকোন একটাতে উঠে পড়লেই আপনি একদম সোজা সেন্ট মার্টিন পৌঁছে যাবেন। 

কিন্তু নানাবিধ কারণে আমাদের ঢাকা থেকে জাহাজের টিকেট করে আসা সম্ভব হয়নি। এদিকে জাহাজ ছাড়ার একদম আগমুহূর্তে এসে জাহাজের স্টাফরা সাধারণ টিকেটের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে হাঁকাতে লাগলো। উপায়ান্তর না দেখে আমরা জাহাজে যাওয়ার ইচ্ছা বাদ দিয়ে বিকল্প পন্থা ধরলাম।

আপনি যদি এমন একজন হন যে কীনা একটু অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাহলে আপনার জন্য এই বিকল্প পন্থাটি বেশ কাজে দেবে। টেকনাফ থেকে প্রতিদিনই কয়েকটি ট্রলার ছেড়ে যায় সেন্ট মার্টিনের দিকে। অনেকেই ঠেকায় পড়ে আবার অনেকেই শুধুমাত্র অ্যাডভেঞ্চারের তাগিদে জাহাজ বাদ দিয়ে চড়ে বসেন এই ট্রলারের উপর। 

যেহেতু জাহাজে চড়ার কপাল আমাদের ছিলোনা তাই আমরা সকালের সেই কড়া রোদের মাঝে উঠে বসলাম ট্রলারে। আগেই বলে রাখা ভাল ট্রলারে যাতায়াত জাহাজের চাইতে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশিই বিপদজনক। এজন্য শুধুমাত্র যখন আবহাওয়া একদমই পরিস্কার থাকে শুধুমাত্র তখনই ট্রলারে চড়ার চেষ্টা করাটা সমীচীন।

সেন্ট মার্টিন পৌঁছেই আমরা চেকইন করলাম ঢাকা থেকেই বুক করে রাখা রিসোর্টের রুমে। জেটি থেকে একদম কাছে আর সাগরের তীর ঘেঁষে থাকা রিসোর্টটির কথা আমি কখনোই ভুলবো না। সবাই ব্যাগ রুমে রেখেই এক দৌড়ে চলে গেলাম একদম কাছে থেকে সমুদ্র দেখতে। ঠান্ডা পানি এসে যখন আমাদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল তখন অপূর্ব এক অনুভূতিতে শরীর ও মন জুড়িয়ে আসছিল।

দুপুরের খাবার আমরা খেলাম কাছের একটা খাওয়ার হোটেলেই। সাগরপাড়ের দ্বীপ হওয়ায় এখানে প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ আপনি খেতে পারবেন। পেটপুরে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে বিকেল হতেই আমরা রওনা হলাম সেন্ট মার্টিনের পশ্চিম দিকের একটি সৈকতে কেননা সেখান থেকে খুবই চমৎকার সূর্যাস্ত দেখতে পাওয়া যায়। সৈকত থেকে কেনা ডাব খেয়ে আমরা সবাই একসাথে সূর্যাস্ত দেখতে থাকলাম। 

সেন্ট মার্টিনে ঘন্টা হিসাবে সাইকেল ভাড়া করা যায়। অনেকেই সাইকেল নিয়ে সৈকতের এদিক থেকে সেদিকে ছুটে বেড়াতে লাগলো। আমি আস্তে আস্তে সমুদ্রের অনেক কাছে এগিয়ে গেলাম। জোয়ারের পানিতে ধীরে ধীরে নিজের গোড়ালি থেকে শুরু হয়ে হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে যাওয়ার যেই অনুভূতি সেটা কোনভাবেই ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।

সন্ধ্যার পর সেন্ট মার্টিনের বাজারগুলো বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। সামুদ্রিক স্ট্রিট ফুড খেতে খেতে সময়টা কাটিয়ে দেয়া যায় অনায়াসেই। রাত বাড়লে বসতে পারেন সেন্ট মার্টিনের একমাত্র জাহাজ জেটিতে। দমকা বাতাস আর নাম না জানা লক্ষ লক্ষ তারা আপনাকে উদাস করে তুলতে বাধ্য।

পরদিন সকালে আমাদের প্ল্যান ছিল ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়া। ছেঁড়া দ্বীপ হলো সেন্ট মার্টিনেরও দক্ষিণে আরো ছোট একটি অংশ। জোয়ারের পানিতে এই অংশটি সেন্ট মার্টিন থেকে আলাদা হয়ে যায় বলেই এর নাম দেয়া হয়েছে ছেঁড়া দ্বীপ। সেন্ট মার্টিন থেকে ট্রলারে ছেঁড়া দ্বীপ যাওয়ার সুযোগ থাকলেও আমরা সেখানে যাই পায়ে হেঁটে। 

সমুদ্রের জলজ ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করতে করতে ছেঁড়া দ্বীপ পৌঁছে যাই প্রায় দেড় দুই ঘন্টা পরে। ফেরার সময় আমরা যেদিক দিয়ে গিয়েছিলাম তার ঠিক উল্টো দিক দিয়ে ফেরত আসি। এতে করে পুরো সেন্ট মার্টিন দ্বীপটাই একবার চক্কর দেয়া হয়ে যায়। রাতে মাছের বারবিকিউ দিয়ে ডিনার সেরে শেষবারের মত জেটিতে যেয়ে বসি আমরা। পরদিন আবার আমাদেরকে রওনা দিতে হয় চিরচেনা ঢাকার উদ্দেশ্যে।

ঢাকা থেকে বেশ কিছু ভাল বাস টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের জাহাজ ছাড়ার জেটি পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছে দেবে। এরপর জাহাজে করে সহজেই চলে যেতে পারবেন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। সমুদ্র উত্তাল না হলে ট্রলারেও যেতে পারেন, তবে যেকোন পরিস্থিতিতে জাহাজে যাওয়াই উত্তম। 

থাকার জন্য সেন্ট মার্টিনে প্রচুর পরিমাণ হোটেল ও রিসোর্ট আছে। কিন্তু ব্যস্ত মৌসুমে আগে থেকে বুক না করলে জায়গা পাওয়া মুশকিল। নানারকমের সামুদ্রিক মাছের আধার এই সেন্ট মার্টিন ভোজনরসিকদের জন্য হতে পার খুবই চমৎকার একটি জায়গা। সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের মাঝে আমার দেখা সবচাইতে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি। আশা করা সবারই খুবই ভাল লাগবে এই প্রবাল দ্বীপটি ঘুরে দেখতে। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here