গত বছর এইসময় আমরা মা’কে নিয়ে হাওড়া থেকে ১২৩৬৯ আপ কুম্ভ এক্সপ্রেসে উঠেছিলাম। প্ল্যান ছিল হরিদ্বার (Haridwar) হয়ে হৃষিকেশ (Rishikesh)। আমরা মানে সঙ্গে আমি, ছেলে অগ্নিভ আর স্ত্রী সন্ধ্যা। দুপুর ১টা ১০ মিনিটের ট্রেন হরিদ্বারে পৌঁছল পরদিন বিকেল চারটের পর। হরিদ্বারে মোটামুটি ৫০০ টাকা থেকে হোটেল শুরু। এছাড়া ধরমশালা, গেস্ট হাউস, মিশন, আশ্রমেও থাকতে পারেন। ব্যাবস্থা মন্দ নয়। তবে আগে বুকিং না করে এলে জায়গা পাওয়া সমস্যা। অধিকাংশ আশ্রম ধরমশালা একটু ভেতরে। বেশিরভাগ পর্যটক মন্দিরের শহরে এসে দর্শনের জন্য হর কি পৌরির কাছাকাছি থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। এখান থেকে পরিবহনের সব সুবিধা পাওয়া যায়। আমরাও ছিলাম হর কি পাউরির কাছেই। তাছাড়া দেড় দিনের তো ব্যাপার। তবে আমাদের হোটেলটা বেশ ভাল ছিল।
খাবার এখানে নিরামিষ। তবে কচুরি, পুরী, ফুচকা আর রসমালাই না খেলে হরিদ্বার দেখা হয় না। অম্বল বা অ্যাসিডিটির ভয় নেই। এ তো আর আর্সেনিক বা আয়রন থাকা পানীয় জল নয়। সুতরাং যা খাবেন হজম হয়ে যাবে। তাই আমরা ইচ্ছেমত খেয়েছি আর ঘুরেছি। ওখানে বেশ কিছু হোটেলের নিজস্ব গঙ্গার ঘাট (ganga ghaat) আছে। ফলে আমার মা’র মত প্রবীন নাগরিকদের গঙ্গাস্নানের খুব সুবিধা। আর হরিদ্বারে এসে গঙ্গাস্নান করবেন না? চিন্তাই করা যায় না। হরিদ্বারে (Haridwar) দু’বেলা এক ঘন্টা করে আরতি হয়। সন্ধ্যা ৬টার আরতি দেখতেই বেশি ভীড় হয়। গঙ্গার ঘাটে আগুনের পরশমনি, সঙ্গে ঘন্টাধ্বনি আর পন্ডিতদের সমবেত মন্ত্রোচ্চারণে এক মায়াবীয় আধ্যাত্মজগৎ সৃষ্টি করে। হর কি পৌরির এই আরতি দর্শন সারা জীবনের এক অপরূপ অভিজ্ঞতা। এভাবেই প্রথম দিনটা কেটে গেল। কালকের সারাদিন যতটুকু পারব মা’কে নিয়ে মন্দিরগুলো দর্শন করাব। খুব সকালে উঠে হরিদ্বারকে দেখার বড় ইচ্ছা। ভোরে ওঠা আমাদের অভ্যেস। সন্ধ্যার সকালে ইস্কুল। ছেলেও কালিম্পঙে ইস্কুল শেষ করে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন কলেজ থেকে বেরিয়ে যাদবপুরে ইতিহাস নিয়ে মার্স্টাস করছিল। আর আমার মা’র উৎসাহ নিয়ে তো কোনও কথা হবে না।
পাহাড়, সমুদ্র বা নদী- যে কোনও জায়গা থেকেই সূর্যোদয় দেখা অপূর্ব অভিজ্ঞতা। কিন্তু হরিদ্বারের (Haridwar’s) গঙ্গা ঘাট থেকে সূর্যোদয় সত্যিই অভূতপূর্ব। যে যাই বলুন না কেন, আমার বারবার মনে হয়েছে, হরিদ্বারে গঙ্গা যেন অন্য একটা মাত্রা জুড়ে দিয়েছে।
এখানকার অলি গলিতে ধূপের গন্ধ, ঘন্টাধ্বনি। আর মন্ত্র উচ্চারণের আধ্যাত্মিক কলরব। ঈশ্বর অবিশ্বাসীকেও মুহূর্তের জন্য উদাস করে দেয়। গলি থেকে বেরিয়ে প্রাতরাশের জন্য পুরী-সবজি আর রসমালাই কিনে হোটেলে ফিরলাম। এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে মন্দির দর্শনে বেরোলাম। পাহাড়ের উপরে অনেক মন্দির। হেঁটে ওঠা যায়। আমরা একটা কেবল কার ভাড়া নিয়েছিলাম। ওখানে মনসা মন্দির খুব বিখ্যাত। লোকে বলে ভক্তরা মনের ইচ্ছা জানিয়ে পুজো দিলে নাকি মনসকামনা পূর্ণ হয়। এছাড়া নদীর পাড়ে মায়া দেবীর মন্দির। কত মন্দির! দেখে সহজে শেষ করা যায় না। তবে পাহাড়ে পাবেন আপনার মাথার উপরে কলরবে মুখর পাখিদের।
হরিদ্বারে দু’ রাত কাটিয়ে এবার সকালে একটা গাড়ি বুক করে সবাই মিলে হৃষিকেশের (Rishikesh) পথে রওনা দিলাম। গাড়ি ভাড়া হাজার টাকার মত। ২৫ কিমি পথ। আপনি বাসেও যেতে পারেন। পৌঁছে যাবেন ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে। রাম ঝুলার কাছাকাছি আমাদের হোটেল বুকিং ছিল। হৃষিকেশেও বাজেট অনযায়ী হোটেল সহজেই পেয়ে যায়। এছাড়া একটু ভেতরে হলেও বেশ কম ভাড়ায় পাবেন গেস্ট হাউস, ধরমশালা ও আশ্রম। তবে আগাম বুকিং থাকা ভাল। উত্তরাখন্ডের (Uttarakhand) হৃষিকেশ গাড়োয়াল হিমালয়ের প্রবেশ পথ। হিমালয়ের উপরে, গঙ্গা নদীর তীরে শান্ত একটা শহর। দেরাদুন জেলার ছোট্ট এই জায়গাটা প্রকৃতি নিজের মত করে সাজিয়েছে। আর তার সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে মানুষ গড়েছে আধাত্ম্যজগতের নানা ক্ষেত্র। এখানে আছে অসংখ্য প্রাচীন মন্দির। এই শহর বিশ্বের যোগা রাজঘানী। হিন্দুদের কাছে হৃষিকেশ এক অনন্য সাধারণ তীর্থযাত্রা।
হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে ৩০ কিমি দূরে নীলকণ্ঠ মাধব মন্দিরে শিব দর্শনে গেলাম। শিব এখানে নীলকণ্ঠ। কথিত আছে মহাদেব এখানে কঠিন তপস্যায় বসেছিলেন। এখানকার মানুষ নিজেদের নানা মঙ্গল কামনায় এই মন্দিরে এসে পুজো দেন। অনেকটা আমাদের তারাপীঠে যেমন অনেকেই মানত করে পুজো দিতে যান, সেরকম। গভীর অরণ্য মন্দিরকে ঘিরে আছে। মন্দিরটি প্রায় ১৪০০ ফুট উঁচু। ২০০৯ সালে এই উত্তরাখন্ডের উপর দিয়ে গেছে মহা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বহু মানুষের মৃত্যু দেখেছে। অসংখ্য মানুষ ও জীবজন্তু জলের তোড়ে ভেসে গেছে। এমন কি ঐ দুর্যোগে বিপন্ন মানুষদের উদ্ধার করতে গিয়ে ভারত সেবাশ্রমের অনেক কর্মীকেও প্রবল জলস্ফীতি গ্রাস করেছে। সেই ধ্বংসলীলায় কিন্তু নীলকণ্ঠ মন্দিরের কোনও ক্ষতি হয় নি।
নীলকণ্ঠ মন্দির থেকে বেরিয়ে লক্ষণ ঝুলায় পৌঁছতে বেশ দেরি হয়ে গেল। গঙ্গার বুকে লক্ষণ ঝুলার সেতু। গাড়োয়ালের তপোবন ও তেহরি গ্রামের মধ্যে যা সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। দু’কিলোমিটারের এই ব্রিজ দিয়ে নিচের দিকে নামলেই রাম ঝুলা। মানুষের সঙ্গে মোটরবাইকও যাচ্ছে। গত বছর যখন গিয়েছিলাম তখনই ব্রিজের হাল খারাপ ছিল। আমরা গিয়েছিলাম মে মাসে। পরে শুনেছি, সমান্তরাল আর একটা ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু হলেও মানুষের চলাচল বন্ধ করা যায়নি। তবে মোটরবাইক চলা বন্ধ হয়েছে। লক্ষণ ঝুলা ব্রিজ থেকে পাশের মন্দির ও কাছে থাকা পাহাড়ের দৃশ্য যেন পটে আঁকা ছবি। হোটেলে ফিরে আমরা বসে থাকতাম। সঙ্গী গঙ্গা। মন ভালো হয়ে যেত। পেতাম নির্মল আনন্দ। নদীর স্রোতের মতই সময় কোথা দিয়ে যে চলে যেত।
এদিন আমরা গেলাম পরামার্থ নিকেতন আশ্রমে। গঙ্গার তীরে হৃষিকেশের প্রধান রাস্তার ওপরে। হৃষিকেশের সবচেয়ে বড় আশ্রম। এখানকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। আশ্রমের ঘরের সংখ্যা এক হাজার। এখানে বিশ্বের নানা জায়গা থেকে হাজার তীর্থযাত্রীর থাকার ব্যাবস্থা আছে। পরিষ্কার, পরিছন্ন ও পরিপাটি ব্যাবস্থা। আশ্রমের মধ্যেই আছে অপূর্ব এক বাগান। আশ্রমের মধ্যে গেলেই মন যেন ভাল হয়ে যায়। সব মিলিয়ে ছিমছাম পরিবেশ। ঘরের ভাড়া ও খাবারের দামও আয়ত্বের মধ্যে। পরমার্থ আশ্রমে হৃষিকেশের দর্শনের নানা দিক নিহিত আছে। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে বিশ্বজনীন প্রার্থনা, যোগা ও ধ্যানের ক্লাস হয়। এছাড়া রোজের সৎসঙ্গ, বিভিন্ন বিষয় কেন্দ্রিক বক্তৃতা, কীর্তন এবং সূর্যাস্তে গঙ্গা আরতি দেখার মত। যোগা এখানে বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব পায়। বিনায়াসা যোগা, সাধারণ হঠ যোগা এবং নিদ্রা যোগা হয় গাঙ্গেয় পরিবেশে। রোগমুক্তির মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক গুনে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ চলে।
ছোট্ট শহর হলে কী হবে, দেখে সহজে শেষ হয় না। সবকিছু দেখতে হলে তিন-চার দিন যথেষ্ট নয়। তবু যতই কম সময় নিয়ে আসুন পরমার্থ আশ্রমের মতই ‘বিটলস আশ্রম’। দেখতে আপনাকে হবেই। আগে ছিল চৌরাশি কুটিয়া। ১৯৮৬ সালে লিভারপুলের বিশ্বখ্যাত বিটলস ব্যান্ড আসার পর সব বদলে গেছে। বিটলসের সদস্যরা তাঁদের ব্যান্ডকে উচ্চমার্গে পৌঁছে দিতে ধ্যান করা শিখলেন। শিখলেন যোগা। এরপর চমৎকার সব সুর সৃষ্টি করলেন। এরপর আশ্রম পরিত্যক্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ফের নতুন করে খোলে ২০১৫ সালে। স্থানীয় মানুষ ও ব্রিটলস ভক্তরা ভীড় জমাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে আসতে থাকেন চিত্রশিল্পী, প্রকৃতিপ্রেমী ও ধ্যানে উৎসাহী মানুষজন। আশ্রমের প্রধান আকর্ষণ গঙ্গার পাথর দিয়ে তৈরি ধ্যান করার ছোট ছোট বাড়ি। বাড়ির ভেতরে অসাধারণ গ্রাফিটির কাজ। বেদ ভবনের দেওয়ালে আঁকা বিটলস সদস্যদের ছবি।
শুধু দেবভূমি, যোগা ও ধ্যান নয়, এখানকার rafting কে অনেকেই বিশ্বের সেরা বলে থাকেন। লাইভ জ্যাকেট পরে একটা রবারের ভেলায় চড়ে গঙ্গার স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস। ছোট,বড় সবাই এই খেলায় মাতেন। যারা কোনও দিন rafting করেননি, তাদের জন্য আছে বিগিনারস পর্ব। যেখানে কোনও ঝুঁকি নেই। ৯ কিমি থেকে ৩৬ কিমি পথে rafting। সবচেয়ে ঝুঁকি ৩৬ কিমি-তে। যা শুধু অভিজ্ঞ ও পারদর্শীদের জন্য। আমার ছেলে Rafting-এ ভালই মজা করেছে। আমাকে অবশ্য মা অনুমতি দেননি।
হৃষিকেশে নিরামিশ ছাড়া আমিষ খাবারের আশা ত্যাগ করাই ভাল। এছাড়া মদ্যপানও নিষিদ্ধ। সকালে হোটেলে প্রাতরাশ করলে ভাল। না হলে জার্মান বেকারিতে গিয়ে একগ্লাস হট চকলেট নিয়ে গঙ্গার ধারে বসুন। কোথা দিয়ে সময় কেটে যাবে, নিজেই টের পাবেন না। এছাড়া ইটালিয়ান হোটেল আছে। বিদেশীরা বেশি ভীড় করলেও ওখানে নানা ধরনের খাবার পাবেন। দুপুরের নিরামিষ খাওয়ার জন্য চটিওয়ালা আছে। দাম একটু বেশি হলেও মশালাদার খাবার উপাদেয় এবং শরীর খারাপ করবে না। তবে একটু কষ্ট করলে তন্দুরি চিকেন, চিকেন মশালা, রুটি পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কোথায়, জায়গাটা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে।
এবার আমরা চললাম মুসৌরীর দিকে। তারপর দিল্লি হয়ে কলাকাতা ফিরব। কিন্তু শান্ত, স্নিগ্ধ, গঙ্গার তীর,নীলকন্ঠ শিব, কিংবা পরমার্থ আশ্রম ছেড়ে যে যেতে মন চাইছে না। মনে হচ্ছে, কে যেন অস্ফুটে বলছে, ‘যেতে নাহি দিব’। তবু দেবভূমি হৃষিকেশ ছাড়তেই হচ্ছে। বিদায় হৃষিকেশ(Rishikesh)।