একটা সময় ছিল। যখন ডাক্তারবাবুরা রোগীদের বলতেন, ‘পশ্চিমের কোথাও কিছুদিন ঘুরে আসুন। হাওয়া বদলে শরীর ভাল হয়ে যাবে’। রোগী যদি বলতেন- কোথায় যাব? ডাক্তারবাবুরা বলতেন, ‘রাজগীর, (Rajgir) দেওঘর বা গিরিডিতে যান’। হাওয়া বদলের সেই কথাগুলো লেখকদের, গল্প, উপন্যাসেও উঠে এসেছে। এছাড়াও রাজগীর (Rajgir)নামটার মধ্যে কেন জানিনা বরাবর একটা অমোঘ টান অনুভব করতাম। এরপর অকস্মাৎ একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে একদিনের জন্য রাজগীর যাওয়ার সুযোগ এসে গেল। আমি একা নয়, কলকাতা থেকে আরও তিনজন ছিল। তাদের কাউকেই চিনিনা। ওদের এক প্রতিনিধি যিনি হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির নিচে আমাদের নিতে এসেছিলেন তিনিও আচেনা। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে যাওয়া উচিত কি না প্রথমে ঠিক করতে না পারলেও বেরিয়েই পড়লাম।
বলা হয়েছিল, সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে বড় ঘড়ির নিচে আসার জন্য। আমি সবসময় লেট। কোনোভাবেই সাড়ে সাতটার আগে পৌঁছতে পারলাম না। কিন্তু ঐ জায়গায় আরও পাঁচ-ছজন রয়েছে? তাহলে বাকিরা কারা? ভাবলাম, রাত ৮টা ০৫ মিনিটে পাটনা গরীব রথ এক্সপ্রেস। সময় হয়ে আসছে। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করতে না করতেই শ্যামের বাঁশি বাজতে শুরু করল। ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই দেখি আমার প্রায় পাশ থেকেই এক ভদ্রলোক যে ভাবে কথা শুরু করলেন, তাতে ফোন কোথায় লাগে! আমি কানে ফোন নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতেই উনি ফোন ছেড়ে আমার হাতটা ধরে বললেন, ‘গৌতমবাবু? আমি সুদেব রায়। যে সংগঠনের নিমন্ত্রণে যাচ্ছেন, আমি তাদের সদস্য। ব্যাবসার কাজে কলকাতায় আসতে হয়। তাই আপনাদের নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমার উপর পড়েছে।’ হেসে বললাম – বাকিরা? উনি বললেন, ‘বাকি তিনজনের দু’জন যেতে পারছেন না, শুধু অমলবাবু আর আপনি। এখন পা চালিয়ে চলুন, ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। গল্প পরে হবে’।
ট্রেনে আমাদের অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হল। কথায় কথায় জানলাম, আমার সহযাত্রী আর এক অতিথি অমল বৈদ্য কলকাতার একটি দৈনিক সংবাদপত্রের ‘পড়াশুনা’র বিভাগীয় সম্পাদক। পরদিন ভোর ৪টে নাগাদ আমরা বখতিয়ারপুর নামলাম। সেপ্টেম্বর মাসেও হাল্কা ঠান্ডা। সারারাত ঘুম হয়নি। সুদেববাবু বললেন, ‘কোনো ট্রেনই ডাইরেক্ট রাজগীর যায় না। এখান থেকে সারা দিনে তিনটে ট্রেন রাজগীর (Rajgir) যায়। এখনই ট্রেন আছে। হাওড়ার ট্রেন প্রায়ই লেট করে আসায় কানেক্টিং ট্রেন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আবার চার ঘন্টা পর ট্রেন’। আমদের জন্য স্টেশনের বাইরে গাড়ি ছিল। রাজগীর দেড় ঘন্টা লাগে। গাড়িতে যেতে যেতে ত্রিদিববাবু, জানতে চাইলেন, আগে কখনও রাজগীর এসেছি কি না? তারপর নিজেই বললেন, ‘এত সুন্দর একটা জায়গা। অথচ, বিহার সরকার পর্যটনের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন’। ওনার থেকেই জানলাম, রাজগীরে হোটেল ব্যবস্থা অতি জঘন্য। তাই এখানে এসে হোটেল ঠিক করা উচিত।
কথা বলতে বলতে কখন যে রাজগীরে (Rajgir) চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। গাড়ি থামল, বিহার পর্যটনের গেস্ট হাউসের সামনে। ওখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। বলতে ভুলে গেছি, ট্রেন থেকে বখতিয়ারপুরে নেমে এক ভাঁড় চা খেয়েছিলাম। ভোরের চা, বেশ ভাল লেগেছিল। মনে হচ্ছিল, আর একবার চা হলে মন্দ হতো না। কিন্তু বাইরের দোকানগুলো তখনও খোলেনি। গেস্ট হাউসেরও একই অবস্থা। অনেক ডাকাডাকির পর গেট খুলল। ত্রিদিববাবু সব ব্যাবস্থা সেরে আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যাবার আগে বলে গেলেন, ‘এখন বিশ্রাম করুন। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠান। ৯টার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকবেন। আমাদের লোক আপনাদের নিতে আসবে’।
গেস্ট হাউসের ঘর বেশ ভাল। প্রথমেই স্নান সেরে নিলাম। ক্লান্তি অনেকটাই কাটল। সাদা বিছানা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একটু গড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করল। ৮টা নাগাদ ক্যান্টিন থেকে ফোন করে জানতে চাইল, ব্রেকফাস্টে কী খেতে চাই? ক্যান্টিন আছে জেনে ভরসা পেয়ে বললাম, আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে জানাচ্ছি। ক্যান্টিনে গিয়ে টোস্ট, ডাবল ডিমের ওমলেট আর চা নিলাম। তখনই অমল বৈদ্য আমার মনের কথাটা বললেন। ভাবছি- দু’দিন থেকে নালন্দা (Nalanda) আর রাজগীরটা (Rajgir) দেখে ফিরব। যাবেন নাকি? বললাম, তাহলে তো ভালই হয়।
গেস্ট হাউসের ঘর বেশ ভাল। প্রথমেই স্নান সেরে নিলাম। ক্লান্তি অনেকটাই কাটল। সাদা বিছানা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একটু গড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করল। ৮টা নাগাদ ক্যান্টিন থেকে ফোন করে জানতে চাইল, ব্রেকফাস্টে কী খেতে চাই? ক্যান্টিন আছে জেনে ভরসা পেয়ে বললাম, আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে জানাচ্ছি। ক্যান্টিনে গিয়ে টোস্ট, ডাবল ডিমের ওমলেট আর চা নিলাম। তখনই অমল বৈদ্য আমার মনের কথাটা বললেন। ভাবছি- দু’দিন থেকে নালন্দা আর রাজগীরটা দেখে ফিরব। যাবেন নাকি? বললাম, তাহলে তো ভালই হয়।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে (Nalanda University) পৌঁছতে ৪৫ মিনিট লাগে। প্রবেশমূল্য বছর তিনেক আগে ছিল ১৫টাকা। এই বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পাওয়া। রক্ষণাবেক্ষণে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। তবে সব কিছু জানতে আমরা ২০০টাকা দিয়ে একজন গাইড নিয়েছিলাম। দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভগ্নস্তূপের পাশাপাশি আধুনিকীকরণও। বলে রাখা ভাল, ভারতীয় পুরাতত্ব বিভাগ এখনও আগের ধ্বংসস্তূপ খুঁজে বার করার কাজ করে চলেছে। নালন্দার (Nalanda’s) ইতিহাস বর্ণময়। এই বিশ্ববিদ্যালয় আনুমানিক পঞ্চম ও ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু। খ্যাতি গুপ্ত বংশের আমলে। এখানকার আধুনিক ছাত্রাবাসের জলের কুয়ো, রান্নাঘর, অধ্যাপকদের থাকার জায়গা দেখলাম। পাশাপাশি দেখলাম পুরাকালের ৯-১০টি ছাত্রাবাস। ছাত্রাবাসের বাইরে একটা করে বৌদ্ধমন্দির। দিনের শুরু ও শেষ ক্লাসের পর ছাত্রদের পুজো করাটা বাধ্যতামূলক ছিল। প্রত্যেক ছাত্র ও শিক্ষকদের আলাদা আলাদা ঘর ছিল। ছাত্রদের সব কাজ নিজের হাতে করতে হতো। সেযুগে নালন্দা ছিল সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম। সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদি বিষয় পড়ানো হতো। তা বলে এখানে ইচ্ছা করলেই পড়ার সুযোগ মিলত না। দেশ-বিদেশ থেকে ছাত্ররা আসতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা ছিল বেশ কঠিন। জেনে অবাক হয়েছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগে প্রবেশদ্বারে থাকা দ্বারপালের কাছে বাইরে থেকে আসা ছাত্রদের পরীক্ষা দিতে হতো। উত্তীর্ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি মিলত। না হলে সেখান থেকেই ফিরে যেতে হতো। এই পদ্ধতিতে বছরে ৩০শতাংশ ছাত্র নালন্দায় ভর্তি হতে পারত। ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে যদি এতটাই কড়াকড়ি, তাহলে অধ্যাপকদের মান কেমন ছিল ভেবে নিন। ছাত্রাবাসের বাইরে অনেক বৌদ্ধমন্দির। কিন্তু তারমধ্যেই আলাদা করে সম্রাট অশোকের সময়ে তৈরি স্তূপ চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি। ভালোভাবে ঘুরে দেখতে কম করে ঘন্টা তিনেক লেগেছে। এরই সঙ্গে মনে হয়েছে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষামূলক ভ্রমণের জায়গা হিসেবে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর কাছে অবশ্যই থাকা হওয়া উচিত।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়(Nalanda University) থেকে বেরিয়ে এবার পাওয়াপুরী। গাড়িতে ২০ মিনিট লাগে। হ্রদের মাঝখানে জৈনদের শ্বেতপাথরের মন্দির। হ্রদের পাশ থেকে একটা রাস্তা বের করা হয়েছে। ঐ পথ মন্দিরে পৌঁছতে হয়। মন্দিরে হেঁটে যাওয়ার সময় জলের মধ্যে মাছ, হাঁসদের দেখতে পেলাম। এরপর কথামত গাড়ি পাওয়াপুরী থেকে আমাদের গেস্ট হাউসের কাছে ফিরিয়ে দিল।
ফিরতে ফিরতে প্রায় বেলা তিনটে হয়ে গেল। দুপুরের খাওয়া সারতে সোজা গেস্ট হাউসের ক্যান্টিনে গেলাম। কিন্তু কিছুই পেলাম না। বলে গেলে এমনটা হতো না। বাধ্য হয়েই বাইরে গিয়ে একটা হোটেলে গিয়ে রুটি, চিকেন আর রায়তা দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারতেই সাড়ে চারটে বেজে গেল। সারটা দিন ঘোরাঘুরির ফলে খুব ক্লান্ত লাগছিল। ঘরে গিয়ে ভাল করে স্নান সেরে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যের পর বেরিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরলাম। পরদিন রাজগীর দেখতে বেরোব। টাঙ্গা হল একমাত্র বাহন। দু’চার জায়গায় দরদস্তুর করে লাভ হল না। ১২০০টাকাই দিতে হবে। স্নান সেরে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরে আসার পর রাতেই কলকাতায় ফেরার ট্রেন। ব্রেকফাস্ট গরম গরম কচুরি, মালপোয়া,সবশেষে বড় ভাঁড়ে চা। রাজগীর (Rajgir) দর্শন শুরু করলাম “জরাসন্ধের আখড়া” দিয়ে। এখানে ভীম ও জরাসন্ধের যুদ্ধ হয়েছিল। কাছেই বিম্বিসারের খাজাঞ্চিখানা বা স্বর্ণভান্ডার। এখানে গুপ্তদ্বারের গায়ে শঙ্খলিপিতে যা লেখা আছে তার পাঠোদ্বার এখনও না হওয়ায় বিম্বিসারের ধনসম্পদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাজগীরের অন্যতম আকর্ষণ শান্তিস্তূপ অবস্থিত গৃদ্ধকূট পাহাড়ের মাথায়। সেখানে যেতে হয় রোপওয়ে করে। মাথাপিছু ১০০ টাকা ভাড়া। সকাল ৯টা- ১২টা ও দুপুর ২টো- ৫টা চালু থাকে। কিন্তু রোপওয়ের জন্য যা লম্বা লাইন তাতে দু’ঘন্টা লেগে যাবে। ইচ্ছাটাই চলে গেল। তবে, জায়গাটার স্নিগ্ধতায় মনটা ভরে গেল। কথিত আছে, এখানে প্রতি বর্ষায় বুদ্ধ তাঁর প্রিয় শিষ্যদের উপদেশ দিতেন। সুজাতার হাতের বানানো মিষ্টি নাকি তিনি এখানেই গ্রহণ করতেন। বিম্বিসার এখানে বুদ্ধর কাছে দীক্ষা নেন। তিনি রথে চড়ে যে জায়গায় নামতেন তা আজও লোক মুখে ‘রথকে উতোর’ নামে পরিচিত। শান্তিস্তূপের শুভ্রতা মনের কালো মেঘ কাটিয়ে দু’দন্ড শান্তি দেয়। বিম্বিসারের শত্রু ছিলেন পুত্র অজাতশত্রু। পিতাকে বিম্বিসারের কারাগারেই বন্দী করে রেখেছিলেন। সেই কারাগার থেকে বিম্বিসার গৃদ্ধকূট পাহাড়ে সফররত বুদ্ধকে দেখতে পেতেন।
এছাড়াও রাজগীরে অজাতশত্রুর তৈরি দূর্গ, যা বর্তমান ধ্বংসস্তূপ। তাছাড়া ভৈরব পাহাড়ের পাদদেশে আছে উষ্ণ প্রসবন। গরম জলের কুন্ড দেখতে যাবার পথে বেনুবন পড়ে। বিম্বিসার ওই জমিটা বুদ্ধকে দান করেছিলেন। এখানকার উষ্ণ প্রসবনের জলে সালফার আছে। অনেকেই রোগ নিরাময়ের আশায় স্নান করছেন। অনেকটা আমাদের বীরভূম জেলার বক্রেশ্বরের মতো। তবে রাজগীরের উষ্ণ প্রসবন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। রাজগীর ঘোরার বহুদিনের সুপ্ত ইচ্ছা পূর্ণ করে গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম।