ঐতিহাসিক শহর যত নিরিবিলি হয় ততই ভালো, মনে করুন দিল্লি বেড়াতে গেছেন, কাবুলি দরওয়াজার সামনে ভাবার চেষ্টা করছেন এই জায়গাতেই বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্রদের খুন করা হয়েছিল! লালকেল্লায় ঢুকছেন। ভাবছেন, এই পথ দিয়ে একদিন শাজাহান হাঁটতেন, আজ আমি সেই পথ দিয়েই… অমনি সুভেনির কোম্পানির চেঁচামেচিতে ধ্যান ভঙ্গ। যদি ঐতিহাসিক জায়গায় বেড়াতে ভালবাসেন আর এই সব সমস্যায় বারবার বিরক্ত হন, তাহলে চলুন খাজুরাহো (Khajuraho) থেকে ৩-৪ দিনের জন্য ঘুরে আসি। এই জায়গাটার নাম জগৎজোড়া হলেও তেমন জমজমাট নয়। বড় বড় বাড়ি নেই। শহরতলির মতো ছিমছাম ভাব আছে। ভীড় যা আছে, তা মন্দিরের আশপাশে। তবে দু’হাত ছাড়া হোটেলগুলোও সেখানে।
সেটুকুও এড়াতে চান, মন্দির থেকে একটু দূরে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজিমের ‘হোটেল পায়েল’-এ মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করুন। শান্ত শহরের মতই শান্ত নিরিবিলি একতলা হোটেল। সামনে সবুজ ঘাসের লন-বাগান, পিছনে সারিসারি পলাশ গাছ, মাথার ওপরে ধনেশ পাখির ওড়াওড়ি। অথচ সবরকমের সুবিধা। সুইমিং পুলও আছে। আর আছে অনেকগুলো সাইকেল। ভাবছেন সাইকেল আবার কেন? যদি আমার পরামর্শ শোনেন, তাহলে বলব, খাজুরাহো শহরটাকে ঘুরে দেখতে চারচাকার গাড়ি নয়, বরং একটা সাইকেল ভাড়া করুন। মোটামুটি চালাতে পারলেই হবে। রাস্তা খুব ভালো, আর গাড়ির সংখ্যাও কম। দুর্ঘটনার ভয় নেই বললেই চলে।
সাইকেল চালিয়ে প্রথমেই চলে যান ওয়েস্টার্ন গ্রুপ অফ টেম্পলে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্গত এই মন্দিরগুলোই খাজুরাহোর মূল আকর্ষণ। মন্দির চত্বরে ঢুকে গেলে বাইরেরে হোটেলগুলো আর চোখে পড়ে না। লোকজনও বেশি নেই। আসলে বেশিরভাগ পর্যটক খাজুরাহোতে আসেন আদিরসাত্মক মূর্তি দেখতে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, খাজুরাহোর মন্দিরের গায়ে যত মূর্তি আছে তার মধ্যে অশ্লীলতা নেই। বেশ কয়েকবছর আগে ‘ছেড়া তমশুক’, ‘স্ত্রীর পত্র’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রর পরিচালক পুর্নেন্দু পত্রীর কাছে লিটল ম্যাগাজিনের জন্য সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। বিষয় ছিলঃ ‘সাহিত্যে শ্লীলতা বনাম অশ্লীলতা’। মনে পড়ে তিনি সুন্দর একটা উপমা দিয়ে বলেছিলেন, ’শিশিরের স্তন থেকে ঝরে পড়ে জল’। যার ব্যাখ্যা ছিল, একে অশ্লীল বা নগ্নতার চোখে না দেখে শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখতে হবে। তাই খাজুরাহোর (Khajuraho) মূর্তি দেখে নগ্নতা আর অশ্লীলতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না।
আদিরস দেখার সাধ মিটে গেলেই দেশী পর্যটকরা মন্দির ছাড়েন। বরং আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকেন বিদেশীরা। আপনিও দেখুন, লক্ষণ, চিত্রগুপ্ত, কান্দারিয়া, মহাদেব, বিশ্বনাথ একের পর এক মন্দির। মূর্তিগুলোর দিকে ভালো করে দেখুন, ভাবুন পাথরের শরীর এত কোমল হয় কোন জাদুতে? রক্তমাংসের শরীরেও বোধ করি এত পেলবতা থাকে না। বারবার দেখুন। প্রথমে গাইডের সাহায্য নিন, তারপর নিজের মত করে দেখুন। তবে দোহাই মূর্তিগুলোর গায়ে হাত দেবেন না। বারবার হাত দেওয়ার ফলে মূর্তিগুলো দিনে দিনে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
দেখে দেখে যখন আশ মিটবে(যদি আদৌ মেটে), তখন রওনা দিন ইস্টার্ন গ্রুপ অফ টেম্পলের দিকে। এবার গ্রামের পথ। পদ্মাদীঘির ধারে বহ্মা মন্দির, ঘুঁটে দেওয়া দেওয়ালের কাছে জাভরি মন্দির, বামন মন্দিরের পাশের জলাশয়ে মোষ স্নান করছে। ইস্টার্ন গ্রুপের আসল আকর্ষণ জৈন মন্দিরগুলি (Jain temple)। এর কয়েকটি মন্দিরে এখনও পুজো হয়। আর কার বুদ্ধিতে জানি না, এই সব মন্দিরের তথাকথিত অশ্লীল মূর্তিগুলিকে প্লাসটার করে দেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে এসে কী করবেন তা নিয়ে একটু সমস্যা আছে। যাকে বলে উভয়সঙ্কট। এই সময়ে একদিকে ওয়েস্টার্ন গ্রুপ অফ টেম্পলে হয় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো। অন্যদিকে একটি অডিটোরিয়ামে বসে মধ্যপ্রদেশের লোকনৃত্যের আসর। আপনি কোনটা দেখবেন সেই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। যেটাই দেখুন, রাতে হোটেল পায়েলে পেট পুরে পছন্দের ভেজ বা নন ভেজের রকমারি লোভনীয় পদ পেট পুরে খান। তারপর সামনের লনে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনুন। মনে হবে, শো দুটো একই সময়ে না দিলে একদিনেই দু’টো দেখে নেওয়া যেত, একটা বাকি থাকত না।
পরদিন সকালে আবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। গতকাল যে মন্দিরগুলো ভালো করে দেখা হয়নি, সেগুলো আবার দেখুন। এখনও তো সাদার্ন গ্রুপের মন্দিরগুলো দেখাই হয়নি। সেগুলো দেখে হোটেলে ফিরুন। যে শো’টা দেখা হয়নি, দেখে নিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুম। রাত পোহালেই তো খাজুরাহোকে বিদায় জানাবার দিন। তাই খাজুরাহোকে (Khajuraho) মনে মনে ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে আসুন।
কী ভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে খাজুরাহোর (Khajuraho) দূরত্ব ১০৫৯ কিমি। মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোতে সরাসরি ট্রেন যায় না। যায় সাতনা পর্যন্ত। হাওড়া থেকে সাতনা যাবার দুটি ট্রেন আছে। শিপ্রা এক্সপ্রেস ছাড়ে সন্ধ্যা পৌনে ছ’টায়। পৌঁছয় পরের দিন সকাল ১১-১০ মিনিটে। এছাড়া পাবেন ১২৩২১৪ আপ মুম্বাই মেল রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে ছাড়ে। পৌঁছয় দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ। ট্রেনে দূরত্ব ৯৭৩কিমি। এরপর বাস বা গাড়িতে খাজুরাহো ৮৬কিমি। সুতরাং, হাতে সময় থাকতে থাকতে খাজুরাহো যাবার প্ল্যান সেরে নিন আর ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।