সকালে কলকাতা ছেড়ে যখন কাঠগোদাম পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। স্টেশনের বাইরে নেগিজী বলল “নমস্তে সাহাব গাড়ি পর আইয়ে”। অন্ধকার পাহাড়ি পথ চিরে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পেরিয়ে পৌঁছলাম “বার্ডার্স ডেন” (Bird’s den) সাততাল (Saat tal)। সাততাল (Saat tal) ভ্রমণ মানচিত্রে কোন উজ্জ্বল নক্ষত্র নয়। নৈনীতাল থেকে ঘন্টা খানেক দূরত্বে লোয়ার হিমালয়ের মেহেরগাও উপত্যকায় অবস্থিত একটি ছোট্ট শান্ত পাহাড়ি শহর।আর তার মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট পাহাড়ি নদী চাফিম্যানেজার আমাদের ঘরে পৌঁছে দিলেন,আর বলে গেলেন কাল সকাল ছটায় রেডি হয়ে থাকবেন।
বার্ডিং মানচিত্রে সাততাল (Saat tal) সর্বজনবিদিত। প্রায় সাড়ে তিনশো প্রজাতির পাখির বাস এই সাততালে। এছাড়াও আছে কুড়িটি প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব এবং সাড়ে পাঁচশো রকমের প্রজাপতি। কালিজ ফিজেন্ট,ব্ল্যাক ফ্রাঙ্কোলিন,মেগপাই রবিন,উডপেকার ও লাফিংথ্রাস এখানকার প্রধান আকর্ষণ,আর এদের টানেই এতদূর আশা।
পরদিন ঠিক ভোর ছটায় বেয়ারা চা নিয়ে এসে বলে গেল “সাহাব জলদি হাইডপে আ যাইয়ে”। কোনরকমে ক্লান্ত দেহটাকে তুলে ক্যামেরা নিয়ে যখন হাইডে বসলাম তখন পুরো আলো ফোটেনি। ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা হাওয়া তিরের মত এসে বিঁধছে। আলো ফুটতেই বেয়রা কিছু দানা ছড়িয়ে দিয়ে গেল। দুই মিনিট যেতে না যেতে উপস্থিত এক পুরুষ কালিজ ফিসেন্ট। তার নীল রংয়ের দেহের উপর বিধাতা ছাই রংয়ের পালক দিয়ে এক অনবদ্য নকসা এঁকেছে।মেরুদণ্ডের উপরের জায়গায় আবার সাদা কলকার কাজ।
চোখটা গাড় লাল দিয়ে রাঙানো,আর মাথায় একটি নীল রংয়ের পালকের ঝুটি। সত্যিই সাততালের (Saat tal) সে প্রধান আকর্ষণ । কয়েক মিনিটের ব্যবধানে প্রবেশ করল তার সঙ্গিনী। ফিমেল কালিজের রং বাদামী কিন্তু তার গায়েও ছাই রংয়ের সেই অপরূপ কারুকলা
দুজনার রূপের এই অপরূপ যুগলবন্দীর মধ্যেই প্রবেশ করল রেডবিলড লিওথ্রীক্স বা জেপানিস নাইটেঙ্গেল। । ছোট্ট ছটফটে এই পাখিটির লাল রাঙা ঠোট নজর কাড়ার মতো।
এরই মধ্যে এসে প্রবেশ করল এক পুরুষ ব্ল্যাক ফ্রাঙ্কোলিন। নিকষ কালো রঙের উপর ভগবান সাদা পাতা এঁকেছে বুকের দিকে,পিঠে বাদামী রঙের কলকা,গলায় গাড় বাদামী রংয়ের গলাবন্ধ। তার উপর ভোরের আলো পরে সে হয়ে উঠেছে আর মায়াবী।
এ রূপ অগ্রাহ্য করার নয়,তাই তার পিছু পিছু এলো তার সঙ্গিনী। তার রূপও কম নয়। তারপর একে একে উপস্থিত হয়েছে ব্লু হুইস্লিং থ্রাস,ব্ল্যাক নেপড উডপেকার,ঝগড়ুটে রেড বিলড ব্লু মেগপাই,হোয়াইট থ্রোটেড লাফিংথ্রাস ও আরও অনেকে।
প্রকৃতির এই রংয়ের খেলা দেখতে দেখতে কখন বেলা দশটা বেজেছে টেরই পাইনি। একসাথে এত পাখী কোথাও দেখা সম্ভব,না দেখলে বিশ্বাস হয়না। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আলাপ হল বার্ডার্স ডেনের মালিক,এক অভিজ্ঞ বার্ড গাইড ও এই অনবদ্য হাইডের স্রষ্টা হরি লামার সাথে। সেখানে জেনে নিলাম সাততালের ইতিহাস,বার্ডিং এর খুঁটিনাটি আর আমার সামনের দিনের বার্ডিং প্ল্যান।
দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম চাফী নদীর উদ্দেশ্যে। এবার সাথী গাইড পুষ্কর। নদীর পাশে এসে গাড়ী থামল। পুষ্কর এর সাথে নেবে গেলাম নদীর পাশে। নদীর পাথরের উপর মিলল প্লামবাস ওয়াটার রেডস্টার্ট ও হোয়াইট ক্যাপট রেডস্টার্ট। আমি প্রবল উৎসাহে ছবি তুলছি,হঠাৎ পুষ্করের ডাক “জলদি ইধার আইয়ে স্যার। দেখিয়ে উও তার কি উপার”। তারের উপর বসে আছে একটি ক্রেস্টেড কিংফিসার। তার স্থির দৃষ্টি নদীর জলে,মাছের খোজে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম শিকারের ছবির লোভে,কিন্তু হলোনা।আলো কমে এসেছে,তাই এবার ঘরে ফেরার পালা।
পরের দিন সকালে আবার বেরিয়ে পড়লাম, গন্তব্য শ্যামক্ষেত অঞ্চল। কিছুটা এগোতেই একটা ঠক ঠক আওয়াজে দাড়িয়ে পড়লাম দুজনেই। পুষ্কর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল একটি হিমালায়ন উডপেকার। ক্যামেরা বন্দি করে আবার এগিয়ে চললাম। কিছুটা এগিয়ে বাহাতে বাক নিয়ে ঢুকে পড়লাম একটা বাগানে। তার উপরিভাগে একটি ওয়াচ টাওয়ার। পাশের গাছের মাথা গুলো পরিষ্কার দৃশ্যমান,বার্ডিং এর জন্য আদর্শ। আর সেখানেই মিলল সাততালের সম্পদ। একে একে দেখা দিল ইউরোপিয়ান গোল্ড ফিন্চ,ইয়েলো ব্রেস্টেড গ্রিন ফিন্চ,কমন রোস ফিন্চ,ব্লু থ্রটেড বারবেট,স্লেটি হেডেড প্যারাকিট ও রুফাস বেলিড নীলটাভা ।
কখন যে সকাল দশটা বেজেছে টের পাইনি,হুশ এলো পুষ্করের ডাকে, “সাব ব্রেকফাস্ট কার লি জিয়ে”। পাহাড়ি রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে খাবার খেতে খেতে পুষ্করের ঘোষণা “সাব ইসকা বাদ রেপ্টার্স”। গাড়ি এবার পাহাড়ি পথে উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। বা হাতে বিরাট খাদ, আর ঘন পাইন গাছের জঙ্গল। তারই একটির মাথায় বসে চারটি স্টেপি ঈগল।
পুষ্করের খেয়াল নেই, চোখে বাইনোকুলার, কি যেন খুঁজে যাচ্ছে।একটু পরে আঙুল দিয়ে দেখাল,দুরের একটা গাছে বসে একটি হিমালায়ন গ্রীফন,আর তার নীচের ডালে একটি স্টেপি ঈগল। এদের ওড়ার কায়দা বেশ রাজকীয়। ডানার ওপরের কাজ বেশ দৃষ্টিনন্দন,তারই কিছু ছবি তুলে হোটেলে ফিরলাম।
দুপুরের পর চললাম সাততাল সংলগ্ন সাততাল স্টুডিও এলাকায়। এখানে তেমন কিছু নজরে পরলনা। তাই পুস্করের নির্দেশ মতো পাহাড়ের গা বেঁয়ে বেশ কিছুটা উঠে গেলাম। ঘন জঙ্গল আর তার মধ্যে ঘাটি গেড়েছে একটি ব্রাউন ফিস আঔল। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ ও আমাদের উপস্থিতিতে তার বিরক্তি বেস পরিষ্কার। তাই পত্রপাঠ বিদায় নিলাম। ফেরার পথে আবার উপস্থিত হলাম চাফি নদীর ধারে। এবার প্রকৃতি বিমুখ করেনি। ক্যামেরা বন্দি করলাম ক্রেস্টেড কিংফিশারের মাছ শিকারের বিরল দৃশ্য। খাবার আগে মাছটিকে শূন্যে ছুড়ে যে জাগ্লিং সে দেখাল তা অনেক দিন মনে থাকবে। আর উপরি পাওনা হিসাবে মিলল স্লেটি ব্যাকড ফর্কটেল ও সাইবেরিয়ান স্টোনচেট।
পরের দিন আমরা বেরিয়ে পরলাম মুক্তেশ্বর সংলগ্ন অঞ্চল। কিছুটা পথ পেরিয়ে,গাড়ি রেখে পায়ে হেটে ঢুকে পরলাম এক পাইন সালে ঘেরা জঙ্গলে। সেখানে প্রথম প্রাপ্তি স্ট্রায়েটেড লাফিংথ্রাস,বোধহয় এই সবথেকে ফোটোজেনিক । তারপর পর মিলল এাংরি বার্ড বলে পরিচিত ব্ল্যাক থ্রটেড বুশ টিট।তারপর রুফাস নিলটাভা আর হিমালয়ান ব্লুটেল আর সব শেষে বার টেলড ট্রিক্রিরপার। সাততালের এই প্রাকৃতিক সম্পদ আমাকে সত্যি মুগ্ধ করেছে।
আমাদের পরের গন্তব্য চল্লিশ কিলোমিটার দুরের “প্যাংগট”। কিন্তু সাততাল ছাড়ার আগে আর একবার হাইডে গিয়ে বসলাম। মিলে গেল হোয়াইট ক্রেস্টেড লাফিংথ্রাস। এর শ্বেতশুভ্র শিরস্ত্রাণটি দেখার মত। গ্রিন ম্যাগপাই এর দেখা পেলাম না। রইলো সামনের বারের জন্য। প্যাংগট পৌছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। ছোট্ট পাহাড়ি শহর প্যাংগট, আর আমাদের এখানের ঠিকানা “কাফাল হাউস”। সামনের উপত্যকায় তখন সাদা মেঘের সমুদ্র। আর তার উপর লাল রঙের আভা ছরিয়ে দিয়ে সূর্য অস্ত গেল। অপরূপ প্রকৃতি মনের ক্যানভাসে বাধা পরে রইল। সন্ধ্যা হতে শীত জাঁকিয়ে পড়ল। কোনমতে ডিনার সেরে বিছানায় ঢুকে পরলাম। কাল আবার বার্ডিং আছে যে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পরলাম,লক্ষ্য কোকলাস ও চীর ফিসেন্ট। সঙ্গে আমার গাইড “হরি”। পথে প্রথমে পেলাম কোল টিট। তার পর চেস্টনাট ক্রাউনড লাফিংথ্রাশ আর রক বানটিং । মাঝে রোড শো করে গেল কিছু স্লেটি হেডেড পেরাকিট]। আর তারপর আমার লিস্টে যোগ হল রুফাস সিবিয়া,স্ট্রাইপট লাফিংথ্রাস,ব্লু ফ্রন্টেড রেডস্টার্ট,ফিমেল বুশ রবিন,ব্ল্যাক হেডেড জে, ব্রাউন একসেন্টার ও গ্রে হুডেড ওআর্বলার। অধরা থেকে গেল কোক্লাস ও চির ফিসেন্ট,প্রকৃতি যে চিরকাল খামখেয়ালি।
প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ হয়ে এবার ঘরে ফেরার পালা। সাততালে (Saat tal) এক সাথে এত প্রজাতির পাখি দেখবো তা সত্যি ভাবিনি। কিছুটা ক্যামেরা বন্দি করে আপনাদের জন্য নিয়ে যেতে পারলাম। কিন্তু এত আনন্দের ভিতর কোথাও একটা শঙ্কা থেকে গেল। হারি লামার থেকে জানতে পেরেছি গত কুড়ি বছরে পাখীর সংখ্যা প্রায় তিরিশ ভাগ কমেছে,হারিয়ে গেছে বেশ কিছু প্রজাতি। প্রধান কাড়ন “হেবিটেট লস”। গ্রামের মানুষ চাষ ছেড়ে দিচ্ছে। গজিয়ে উঠছে হোটেল আর বাড়ি,সরকার উদাসীন। প্রশ্ন থেকে গেল, “বার্ডিং এর স্বর্গ রাজ্য সাততালের এই সম্পদ কি আমরা রক্ষা করতে পারবো? পরের প্রজন্ম কি সাততালকে তার সমহিমায় দেখতে পাবে?”।তবে আশায় বুক বেধে আর সাততালে আবার ফিরে আশার অঙ্গিকার নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।