বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ভারতবর্ষ বিভিন্ন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন। আমরা ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত। কিন্তু এই মহান দেশের আনাচে কানাচে কিছু অজানা অচেনা জায়গা আছে যা আমাদের বিস্ময়ের ভাণ্ডারকে আরও বিস্মিত করে। হিমালয়ের কোলে এ’রকম একটি বিস্ময়কর রহস্যেঘেরা ঐশ্বর্যশালী জায়গা মালানা(Malana)। আপনি যদি আ্যডভেঞ্চার প্রিয় হোন, রোমান্স পচ্ছন্দ করে, অফবিট জায়গায় ঘুরতে ভালোবাসেন তাহলে আপনিও চলুন মালানার আদিম উষ্ণতার স্পর্শ পেতে। নিশ্চিত আপনার ভালো লাগবেই।
দেবভূমি হিমাচল(Himachal) প্রদেশের কুল্লু(Kulu) অঞ্চলের উত্তর-পূর্বে পার্বতী উপত্যকার চন্দারখানি(Chandarkhani) এবং দেও টিব্বা(Deo Tibba) পর্বতের মধ্যে ভার্জিন মালানা(Malana) গ্রাম আজও পৃথিবীর মূলস্রোত থেকে অনেকাংশেই বিচ্ছিন্ন। সমুদ্রতল থেকে ২৬৫২ মি. ( ৮৭০১ ফুট) উচ্চতায় মালানা(Malana) নদীর পাশে অবস্থিত চারিদিকে বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের মাঝে সবুজ বনে ঘেরা স্পর্শে নিষেধাজ্ঞা রহস্যময় এই গ্রামের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মিল নেই। দুর্গম পথ অতিক্রম করে এই রহস্যময় গ্রামে পৌঁছতে হয়। এমনকি এই গ্রামের মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের জন্য স্বতন্ত্র এক ভাষার জন্ম দিয়েছে, যাকে বলে ‘কানাসি ‘ ভাষা। তাদের আভ্যন্তরীণ বক্তব্য যাতে বর্হিঅঞ্চলের মানুষ বুঝতে না পারে তাই এই ভাষার সৃষ্টি করা হয়েছিল। এমনকি ‘কানাসি’ ভাষার সাথে বিশ্বের আর কোন ভাষার মিল নেই। কানাসি ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। গবেষণার বিষয়।
রহস্যময় তাদের ধর্মবিশ্বাসও, পৃথিবীর অন্য ধর্মের সাথে সাযুজ্য নেই। তাদের দেবতা “জলমু” ঋষি। এই দেবতার পুজো বা উপাসনার রীতি নেই। তবে উৎসবে তাকে সর্বশক্তিমান দেবতা হিসাবে স্মরণ করা হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে পুজো না করলেও সবার ঘরে ঘরে তার আধ্যাত্মিক বাণী সংরক্ষিত আছে। মালানা গ্রাম পরিচালনা ক্ষেত্রে এই জমলু ঋষির প্রভাব অত্যধিক। সমাজের একজন এই ঋষির প্রতিনিধি। তাকে ‘গুরু’ নামে অভিহিত করা হয়। সমস্ত গ্রাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হলেও গুরুর সিদ্ধান্তের গুরুত্ব থাকে সর্বাধিক। পৃথিবীর অন্য যেকোন জনগোষ্ঠী থেকে তারা নিজেদের উচ্চ ও পবিত্র মনে করে এবং সেজন্য তারা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে অস্পৃশ্য রাখে। মালানা অধিবাসীরা মনে করে তারা গ্রীক সম্রাট আলেকজাণ্ডারের উত্তরসুরি। মালানা গ্রাম বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক গ্রাম। সেজন্য মালানাকে বলা হয় ‘ হিমাচলের এথেন্স ‘। জনশ্রুতি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে যখন ভারতবর্ষ অভিযানে আসেন তখন তাঁর সাথে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ছিল। তাদেরকে সাথে নিয়ে প্রায় ১৯ মাস তিনি ভারতবর্ষে অবস্থান করেন। যখন তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করে করেন সৈন্যদের একটি অংশকে হিমালয়ের(Himalaya) পাহাড় বেষ্টিত গ্রাম মালানায় বসবাস করার আদেশ দেন। সেই থেকে মালানা গ্রামের পথ চলা ।
মানালি থেকে মণিকরণ(Manikaran) যাওয়ার পথে এই রহস্যময় গ্রামকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। আমাদের ড্রাইভার জগৎ ভাই আমাদের মালানা গ্রাম পরিদর্শনে আরও অনুপ্রাণিত করে। জগৎ খুব রোমান্টিক ছেলে। গতানুগতিক চেনা জনপদ ছেড়ে অচেনা অজানা জায়গা তার পছন্দ। আমাদেরও তাই। পথে জরি বলে একটা জায়গা, তারপর গাড়ি চলাচল বন্ধ। সেখান থেকে এক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছলাম মালানা গ্রামের দ্বারপ্রান্তে। ওয়েলস নৃবিজ্ঞানী কলিন রজার ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দে প্রায় ৪৫ কিমি দুর্গম পর্বত জঙ্গল অতিক্রম করে মালানা গ্রামে উপস্থিত হোন। আর এখন তুলনায় অনেক কম ও সহজ পথ। মালানা গ্রামের আগে মালানা হাইড্রো পাওয়ার স্টেশন, যেটি পার্বতী উপত্যকার কুমারী সৌন্দর্যকে খানিকটা হলেও বিনষ্ট করেছে। গ্রামে ঢোকার মুখে চেকপোস্ট, ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ দ্বারা তল্লাশি। কী কারণে মালানা গ্রামে প্রবেশ করতে চাই। সঠিক উত্তর দিতে না পারলে ফিরে আসতে হবে খালি হাতে। মালানার বিখ্যাত মাদক দ্রব্যের জন্য এত কড়াকড়ি।
গ্রামের মধ্যে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ১০০ পড়ুয়া এবং ১ জন শিক্ষক, নিবাস কুল্লু। ওনার কাছ থেকে মালানা গ্রামের অনেক অজানা ভূগোল, ইতিহাস জানতে পারলাম। গ্রামের অর্থনীতি নির্ভরশীল মূলত হাসিস (চরশ) বা গাঁজা চাষের উপর যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। মালানায় উন্নতমানের গাঁজা চাষ ও গাঁজা থেকে বিভিন্ন মাদক তৈরি করা হয়, যা পৃথিবী বিখ্যাত। চরশ নিয়ে নানা কিংবদন্তী কথিত আছে, ক্রুসডের সময় একদল দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধাদের হাসিস খাওয়ানো হতো যাতে তারা শত্রুপক্ষকে নির্দ্ধিতায় হত্যা করতে পারে। আর এই হাসিসের প্রলোভনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাদক সম্রাটরা এখন মালানায় ভিড় করেন। কথিত আছে, মালানার মতো উন্নত মাদক বিশ্বের আর কোথাও তৈরি করা সম্ভব হয় না। মালানার অধিবাসীরা এসব মাদক উৎপাদন পদ্ধতি গোপন রাখেন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে একবার মালানা গ্রামে পাহাড়ের কোলে একসাথে ১২ জন পর্যটকের মৃতদেহ পাওয়া যায় রহস্যজনক ভাবে। অনেক মনে করেন, পর্যটকরা মালানায় উৎপাদিত বিভিন্ন মাদকের ফর্মুলা গোপনে বা জোর করে জেনে নিতে চেয়েছিলেন। তারই পরিণতি এই হত্যাকাণ্ড। গ্রামবাসিরা কোন মতেই গোপন ফর্মুলা প্রকাশিত করতে চায় না। সেই মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকেই প্রশাসনিক কড়াকড়ি মালানা গ্রামে প্রবেশের ক্ষেত্রে। পাহাড়ে ঢালে ঢালে ভুট্টা ও আলুর চাষও চোখে পড়ল।
পথে আমরা জরি থেকেই কিছু শুকনো খাবার সাথে নিয়ে এসেছিলাম। এক জায়গায় বসে সেই শুকনো খাবারেই লাঞ্চ সারলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে দর্শন পেলাম গ্রামের মাঝখানে জমলু মন্দির যার কাঠের দেওয়াল অপূর্ব ‘কথকুনি শৈলীর’ কারুকার্যে পূর্ণ এবং গোটা মন্দির চত্ত্বর শিং বিশিষ্ট হরিণের মাথা দ্বারা শোভিত। কিন্তু ফটো তোলার সাহস হয়নি। মালানা গ্রামের বাড়িগুলো অদ্ভূত। দোতলা বা তিনতলা এবং প্রত্যেক তলার একটি নির্দিষ্ট নাম এবং মানে আছে। নীচের তলাকে বলা হয় “খুডাং” যেখানে গোবাদি পশু, জ্বালানি এবং গোবাদি পশুর খাবার থাকে। দোতলাকে বলা হয় “গেয়িং” যেখানে খাবার, উল এবং পশম মজুত রাখা হয়। সর্বোচ্চ তলায় আছে ঝুলন্ত বারান্দা যা “পাতি” নামে পরিচিত। সর্বোচ্চ তলা বসবাসের জন্য।
কখন যে আস্তে আস্তে মালানা নদীর পশ্চিম দিকে পাহাড়ের কোলে সূর্য ঢলে পড়ছে খেয়াল করি নি। একটা অদ্ভুত সম্মোহনে আবিষ্ট ছিলাম। মনের মধ্যে একটা আলাদা রোমাঞ্চ বয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন একটা ধাঁধার মধ্যে আছি। এই গ্রামে বহিরাগতদের রাত্রিবাস নিষিদ্ধ। মালানা গ্রামের বাইরে রাত্রিবাস করার জন্য কয়েকটি তাঁবু বা থাকার ব্যবস্থা আছে। আমরাও গুটি গুটি পায়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসলাম একরাশ অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভুতি নিয়ে। জানি না কতদিন মালানা গ্রাম তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে। কারণ চারপাশে বিশ্বায়নের রথের চাকা যেভাবে ঘূর্ণায়মান! ঝুপ করে সমগ্র পার্বতী উপত্যকায় হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসলো, গাড়ির মধ্যে উঠে বসলাম। পরবর্তী গন্তব্য মণিকরণ”(Manikaran)। সে গল্প অন্য অবসরে।