রাত্রির হই হট্টগোলের মাঝে কখনো কখনো হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছি, কিন্তু বারেবারেই তাতে ব্যাঘাত ঘটেছে! আজ রাধাষ্টমি, -মেলার শেষ দিন, সকলের মধ্যে ব্যস্ততাও যেন একটু বেশী! –তাই ভোর হতেই আমাদেরও যাত্রার প্রস্তুতি শুরু! ঠিকহয় মালপত্র তাঁবুতে রেখেই আজ যাওয়া হবে মণিমহেশ দর্শণে, দর্শণ শেষে আজই আবার এখানে ফেরা! সকাল ৭টায় ছাতুর সরবত্ গলায় ঢেলে যাত্রা শুরু। তিনদিক উঁচু পাহাড়ে ঘেরা জায়গা, – ধাপে ধাপে পাথর কাটা বিষম চড়াই উঠে গেছে মনিমহেশের দিকে। প্রায় একঘন্টা হাঁটলাম, বিশ্রাম নিতে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরতেই দেখি ধানছো জ্বলজ্বল করছে! হতাশায়, বিরক্তিতে সবারই মেজাজ খারাপ হয়, -‘এতক্ষনে এইটুকু এলাম’! আরও আধঘন্টা চলার পর পেরিয়ে আসি বাঁন্দরঘাঁটির চড়াই, দুর থেকে দেখে যেখানে চড়াইয়ের শেষ মনে হচ্ছিল, সেখান থেকেই শুরু ভৈরবঘাঁটির(Bhairabghati) প্রাণান্তকর চড়াই! নিস্তারহীন চড়াই উঠি ধীর পায়ে, – ফিরতি যাত্রীরা জয়ধ্বনি দেন “হর হর মহাদেব” আমি সেটুকু বলার শক্তিও হারিয়েছি! আমার পরিশ্রান্ত শরীর দেখে অনেকেই উৎসাহদান করেন, – বিশেষ কাজ হয়না! চড়াইয়ের পর চড়াই ভেঙ্গে একসময় বসে পড়ি, পা যেন আর চলে না! চারিদিকে সাদা মেঘের আস্তরণ, দু’হাত দূরের জিনিসও দেখা যায়না, -শুরু হয় সাবুদানার মত বরফ পড়া! চোখবন্ধ করে কতক্ষন বসেছিলাম জানিনা, -পিঠে নরম স্পর্শ, -“বেটা, পরিসান্ হো?” চোখ খুলি, সামনে এক করুণার মূর্তি – শিখ্ বৃদ্ধ! বৃদ্ধ নিজের ঝোলা থেকে একমূঠো কাজু-কিসমিস্ বার করে দেন, -খেয়ে নিতে বলেন, -বলেন, পথ আর বেশী নেই, সামনেই গৌরীকুন্ড(Gourikund), -সেখানে ভান্ডারায় জল, খাবার সব পাব, তারপর আধঘন্টার পথ, তাই খোলা জায়গায় বসে না থেকে আমি যেন হাঁটা লাগাই! কি বিষম এক শক্তি ছিল সেই বৃদ্ধ মানুষটির কথায় – তা আজ এত বছর পরে ভাবলেও শিহরিত হই! দু’পায়ে নতুন করে বল ফিরে পাই – হাঁটা লাগাই গৌরীকুন্ডের পথে! মিনিট দশেক হাঁটতেই দেখা মেলে বরফ আর পাথরে ঘেরা ছোট্ট অপরিসর প্রান্তর – গৌরীকুন্ড, -বাঁপ্রান্তে জলের ধারার নীচে তীর্থযাত্রীদের পরম পবিত্র ছোট্ট হ্রদ! মেঘের চাদর ছিঁড়ে দেখাদেন সূর্যদেবও! ভান্ডারায় খাওয়া সেরে আধঘন্টার চড়াই ভেঙ্গে উঠে আসি – মণিমহেশ! ঘড়িতে সোয়াদুটো। -চোদ্দ হাজার ফুট উচ্চতায় প্রকান্ড এক ‘লেক’! – অসংখ্য তীর্থযাত্রী তাতে পূণ্যস্নান সারছেন, ধূপ জ্বেলে, নারকেল ভেঙ্গে পূজো দেওয়া হচ্ছে! আমার মন পড়ে আছে দিগন্তের উত্তর পানে – মণিকৈলাসের দর্শণে! দর্শণ মেলে – মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য মেঘের আস্তরণ সরিয়ে দেখা দেন তিনি – মণিমহেশ শিখর! – যেন শিবভুমি কৈলাসের ছোট সংস্করন! হাতজোড় করে প্রণাম জানাই! সাড়ে-চারঘন্টা উৎরাই শেষে সোয়া সাতটায় তাঁবুতে ফেরা! রাত্রির খাবার সেরে তাঁবুতে শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম আসেনা, -মাথায় ঘুরতে থাকে দু’দিনের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা