ফ্রেজারগঞ্জের সমুদ্রটি গৃহপালিত বিশেষ। গ্রামের বাড়িতে যেমন খিড়কির পুকুর থাকে, এটি তেমনি খিড়কির সমুদ্র। শোয়ার ঘর, রান্নাঘর, গোয়ালঘরের পাশ কাটিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ সামনে সমুদ্র। গ্রামের লোক সেখানেই নিত্যকর্ম সারেন, পোষা হাঁসগুলো সেখানেই সাঁতার কাটে। সত্যি কথা বলতে কি, পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে না দেখে, মৎসজীবীদের গ্রাম হিসাবে দেখলে ফ্রেজারগঞ্জকে নেহাত মন্দ লাগবে না। দড়িতে ঝোলানো শুঁটকি মাছগুলোকেও বেশ ভাল লাগবে, যখন দেখবেন তার লোভে আকাশে পাক খাচ্ছে খান কয়েক শঙ্খচিল। গ্রামের গঙ্গা মন্দিরটিও ভাল লাগবে। গঙ্গা মন্দিরের সামনে থেকে সমুদ্রের দিকে তাকালে চক্রবাল রেখার গায়ে মেঘের মতো একটা ছায়া দেখা গেল। গাইডবাবু বললেন, “ওটা জম্বুদ্বীপ(Jambudwip)। ওখানে যেউনি, খুব ঢেউ”।
গঙ্গা মন্দিরের কাছে দাঁড়ালে আরও দেখা যায় চওড়া একটা খাঁড়ি স্থলপথের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলারগুলো এই ফাঁড়ি দিয়েই সার বেঁধে ফ্রেজারগঞ্জের ফিশিং হারবারে পৌঁছয়। শুনেছি সে এক দারুন দৃশ্য। কিন্তু একটাও ট্রলার দেখতে পাচ্ছি না কেন? আমাদের বোধহয় দেরি হয়ে গেছে। মন্দিরের চাতালের ওপরে উঠে দেখার চেষ্টা করছি, এমন সময় দূর থেকে শুভজিতের গলা শোনা গেল, “এই তোরা শিগগির আয়। জেটি থেকে মাছ কিনব। আজ মাছভাজা দিয়ে….”। এইসব ব্যাপারে ওরা সাধারণত আমাকে ডাকে না। কিন্তু আজ ডাকার কারণ আছে, টাকার থলি আছে যে আমার কাছে। কিন্তু জেটিতে গিয়ে দেখি সেখানেও সব ঢুঁ ঢুঁ। একটাও ট্রলার নেই। আছে শুধু কটা ভুটভুটি। তারই একটার মাঝির সঙ্গে খোশগল্প জুড়েছে শাম্ব। ভোরের হাওয়ায় শাম্বর মধ্যে বেশ কবি কবি ভাব এসেছে। সে মাঝিদের বলছে, “আপনারা তো জীবন হাতে নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যান”। মাঝিও বেশ বাকপটু। মনে হয় কলকাতার লোকদের এই সব গায়েপড়া কথা শোনা তাঁর অভ্যাস আছে। তিনি বললেন, “আপনারাও তো জীবন হাতে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চালান”। পৃথিবীতে সপ্তম রিপু বলে যদি কিছু থাকে তবে তা হল ‘গ্যাস খাওয়া’। কিছুক্ষণ উভয়ে উভয়ের প্রশনশায় পঞ্চমুখ হওয়ার পর, শাম্বর মধ্যে সেই সপ্তম রিপুর প্রভাব দেখা দিল। সে বলল, “গাড়ি চালান আনার বাঁ হাতের খেল। আমি তো কলকাতা থেকে মদ খেতে খেতে এতো দূর গাড়িচালিয়ে এসেছি। চাইলে আমি নৌকাও চালাতে পারি”। মাঝি মহাশয় বোধহয় এরই অপেক্ষাতেই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “তবে তো আপনাকে নিয়ে জম্বুদ্বীপে যেতেই হবে। কলকাতার বেশির ভাগ লোক এমন ভিতু যে যেতেই চায় না। এই গোবিন্দ নৌকা লাগা, এতদিনে একটা সাহসী বাবুর পেয়েছি”।
নৌকা জেটিতে লাগতেই শাম্ব এবং তার দেখাদেখি অন্যরা লাফিয়ে লাফিয়ে নৌকায় উঠে পড়ল। বললাম, “শাম্ব ওই বাচ্চাটা বলছিল জম্বূ দ্বীপে খুব ঢেউ”।“আরে, তুমি চিরকাল ওই বাচ্চাদের কথাতেই নাচ। এবার পুরুষ হও বুঝেছ, পুরুষ”। আমার আঁতে ঘা লাগল। গ্যাস খাওয়াটা সপ্তম রিপু হলে, ‘আঁতে ঘা লাগা’ অষ্টম রিপু। সেই রিপুর কবলে পড়ে আমিও এক লাফে নৌকায় উঠে পড়লাম। নৌকা জেটি ছেড়ে কিছু দূর এগোতেই শাম্ব উঠে দাঁড়িয়ে হে-হে-হে- বলে চিৎকার করে উঠল। “শাম্ব দাঁড়িয়ে থাকিস না, জলে পড়ে যাবি”।“গেলে যাব। ফ্রেজারও তো ডুবে গেছিল। কত মেয়ে আমাকে উদ্ধার করার জন্য মুখিয়ে আছে। তুমি খালি তাঁদের মধ্যে একটাকে বাছাই করে দেবে”। গোবিন্দ নামের সেই ছোকরাটি ফিসফিসিয়ে বলল, “আপনি চুপ মেরে বসে থাকেন। এখখুনি দ্যাখেন নিজে থেকেই বসে পড়বে”। বলতে বলতেই হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কষার মতো একটা প্রবল ঝাঁকুনি। নৌকা যেন পাগলা ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠল এবং লাফের পর লাফ দিতেই থাকল। “কি হল রে গোবিন্দ”? এজ্ঞে নদী ছেড়ে সাগরে এসে পড়িচি”।
ওদিকে গোবিন্দর কথা সত্যি প্রমান করে, সব কটা বীরপুরুষ ধপধপ করে বসে পড়েছে। শুধু বসে পড়াই নয়, পশ্চাতদেশ ঘষতে ঘষতে একেবারে ছাউনির ভিতরে গিয়ে সেঁধিয়েছে। আমার মন বলছে, সেখানে ঢুকে চোখ বন্ধ করে থাকি। বিপদকে দেখতে না পেলে বিপদের ভয় একটু হলেও কমে। বাস রে সে কি দুলুনি! সে কি ঢেউ! নৌকার ডানদিকে ঢেউয়ের ঝাপ্টা লেগে বাঁদিকে জল ছিটকে যাচ্ছে। জীবনে এমন ভয় খুব কমই পেয়েছি। প্রাণপণে একটা তক্তা ধরে বসে আছি। ফ্রেজারগঞ্জ কতটা পিছনে সেটা দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতেও ভয় করছে।
“সোমক সাঁতার জানিস”? আমি সাইকেল চালাতে জানিনা। কিন্তু দু’বার গঙ্গা এরার ওপার করেছি। দু’বারই দশহরার দিন”। “সাঁতার জেনে লাভ হবেনি বাবু, জলে কামট আছে”। এই কথা শুনে কিনা জানিনা, ছাউনির ভেতর থেকে একটা চাপা গুঁ গুঁ শব্দ ভেসে এল। কোনও এক বীরপুরুষ কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে, কাঁপতে কাঁপতে জম্বুদ্বীপে যখন নৌকা পৌঁছল, তখন হড়হড় করে সবকটা একসঙ্গে বমি করে ভাসিয়ে দিল। বোধহয় ভয়ের চোটে এতক্ষণ চাপা ছিল। নৌকার মধ্যে তখন একেবারে মাখামাখি অবস্থা। কিন্তু নৌকার বাইরে প্রকৃতি আমার সামনে সে কি রূপ মেলে ধরল! সে কী আদিমতা! যে রূপকে লোলুপ পর্যটকরা এতটুকুও বিক্ষত করতে পারেনি। দ্বীপে জনপ্রাণী নেই। নির্জনতায় চারিদিক থমথম করছে। শুধু প্রথম ঋতুরক্তের মতো চাপচাপ লাল কাঁকড়া ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর অঞ্চলে। অগণ্য। একটানা সেদিকে তাকিয়ে থাকলে নেশায় ধরে, মাধবীর নেশা। সে নেশায় উন্মাদ কামুক সমুদ্র মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে জম্বুদ্বীপের শরীরে। দ্বীপে একটা জেটি পর্যন্ত নেই। লাফ দিয়ে নামতে হয় কাদা জলে। সেদিন সেই কাদা জলে খর টান। তবুও মনে হল নামতে আমাকে হবেই। এই রূপকে স্পর্শ করতে হবে প্রতি অঙ্গ দিয়ে। ঠিক তখনই মাঝি বললেন, “নীচে নামবেন না বাবু। সমুদ্রের অবস্থা ভালো নয়। হ্যাঁ বাবু, দেখেন নি আজ কেউ মাছ পর্যন্ত যায়নি”। খুব অবাক হয়ে মাঝির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, এতই যখন দয়া তাহলে সমুদ্রের অবস্থা জেনেশুনেও জম্বুদ্বীপে আমাদের নিয়ে এলে কেন? কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করছিল। এরপরেও সরল মানুষের জন্য ক্ষমাসুন্দর হয়ে শুধু হাসলাম।