বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি! পৃথিবী তো ছেড়ে দিন। নিজের জেলাই কতটুকু চিনি! এই বাঁকুড়া জেলায় এক সময় বিমানবন্দর ছিল। নিয়মিত বিমান নামত। এটাই বা আমরা কজন জানি! সত্যিই, পরতে পরতে কতকিছু অজানা থেকে যায়।
আমরা কথায় কথায় ভিনরাজ্যে যাই। এখন তো বেড়াতে অন্য দেশ যাওয়াটাও জলভাত হয়ে গেছে। কিন্তু নিজের রাজ্য, এমনকী নিজের জেলার দিকে ফিরেও তাকাই না। জঙ্গল দেখতে ডুয়ার্স যাই। কিন্তু নিজের জেলার জঙ্গল মহলে যাই না। আবার সেই রবি ঠাকুরকে ধার করেই বলতে ইচ্ছে করে, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।
অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল, একবার জয়পুরের জঙ্গলে যাব। নানা কারণে যাওয়া হয়ে উঠছিল না। হয়ত এত কাছে বলেই গড়িমসি করছিলাম। শেষপর্যন্ত বেরিয়েই পড়লাম। এমনিতে মোটেই খুব দূরে নয়। বাঁকুড়া থেকে ঘণ্টা দেড়েক। ওন্দা, রামসাগর পেরিয়ে, বিষ্ণুপুর ছুঁয়ে সোজা রাস্তা ধরে গেলেই হবে। বিষ্ণুপুর পেরিয়েই পাবেন মস্ত এক জঙ্গল। দিনের বেলায় তেমন আহামরি মনে হবে না। কিন্তু রাতের বেলায় গা ছমছম করতেই পারে। শুনেছি, একসময় এই জঙ্গলে রাস্তায় গাছ বা বোল্ডার ফেলে ডাকাতি হত। আর শ্রীমান গজরাজের আনাগোনা তো আছেই। মাঝে মাঝেই নাকি রাস্তায় হাতির দল দাঁড়িয়ে থাকে। দু’পাশে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। আর রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের এদিক থেকে ওদিক যাওয়া তো হামেশাই ঘটে।
কলকাতা যাওয়ার নাইট সার্ভিস গুলো এই দিক দিয়েই যায়। রাতে এই পথটা নিশ্চিতভাবেই বাড়তি একটা রোমাঞ্চ এনে দেয়। কিন্তু দিনের বাস সেভাবে যায় না। এখন বাঁকুড়া–কলকাতা বেশিরভাগ বাসই যায় দুর্গাপুর হয়ে। ফলে, এই রাস্তাটা কিছুটা দুয়োরানি হয়ে গেছে। সেই কারণেই অনেকের সঙ্গে জয়পুরের যোগাযোগটাও কমে এসেছে। হয়ত তাই, আত্মীয়তায় ভাটা পড়েছে।
শুনেছিলাম, সেখানে বনলতা রিসর্ট নামে একটা দারুণ ঘোরার জায়গা হয়েছে। অনেকেই ঝটিকা সফরে ঘুরতে যায়। অনেকে দল বেঁধে পিকনিকে যায়। সোশ্যাল সাইটে আমার কোনও অ্যাকাউন্ট নেই। তবু এর–তার মোবাইলে ছবি দেখি। বনলতা নিয়ে নানা আলোচনা শুনি। এখন নানা জায়গায় ফার্ম হাউস বা ইকো ট্যুরিস্ট ভিলেজের কথা শুনি। কিন্তু আমাদের জেলায় তো এসবের তেমন চল নেই। সেদিক থেকে কনসেপ্টটা কিছুটা অভিনব।
রিসর্ট বলতে আমরা ভেবে নিই, শুধু থাকার জায়গা। কিন্তু এটা শুধু থাকার নয়, ঘোরারও জায়গা। সারাদিন এখানেই দিব্যি কেটে যায়। ভেতরে যেন বিশাল এক সাম্রাজ্য। সবকিছু আপনি ভেতরেই পেয়ে যাবেন। একদিকে চাষবাসের বিশাল আয়োজন। ধান তো আছেই। বিশাল জায়গাজুড়ে নানারকম সবজি চাষ। শহর থেকে আসা অনেকে হয়ত জানেই না আলু মাটির তলায় হয় নাকি ওপরে। এখানে এলে পাবেন আলু, ফুল কপি, বাঁধা কপি, বেগুন, কুমড়ো, লাউ, মুলো। রয়েছে নানা ফলের গাছও। আরেকদিকে হাস–মুরগি তো আছেই। সঙ্গে এমু পাখি, টার্কি, তিতির, খরগোশ। কড়কনাথ মুরগির কথা ইদানীং কাগজে মাঝে মাঝেই পড়ি। কিন্তু কখনও দেখার সুযোগ হয়নি। দেখলাম বনলতায় গিয়ে। লাল মোরামের রাস্তা বিছোনো। অলসভাবে যে কোনও রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান। কোথাও কুঁড়ে ঘর, কোথাও পুকুর, কোথাও সবজি খেত, কোথাও এমু পাখির আস্তানা। ঘুরে ঘুরে সবটা দেখে নিন। যাঁরা গ্রামের মানুষ, তাঁদের কাছে সবজি খেত হয়ত নতুন কিছু নয়। কিন্তু যাঁরা শহর বা আধা শহরে থাকেন, তাঁদের কাছে এগুলো নতুনই মনে হবে। বিশেষ করে ছোটরা, মোবাইলেই যাদের শৈশব আর কৈশোর আটকে আছে, তাদের কাছে এই ‘সবুজের অভিযান’ মন্দ লাগবে না। ঘেরা জায়গায় প্রকৃতিকে এক উঠোনের মধ্যে পাওয়ার হাতছানি। আর খাওয়া–দাওয়া! সেটা নিয়েও কোনও চিন্তা নেই। রয়েছে যাবতীয় আয়োজন। কোনওটাই কেনা নয়। সব এখানে বানানো। যা সবজি, সব এখানেই চাষ হয়। এমনকী, রসগোল্লাও এখানকার গরুর দুধেই বানানো। বাইরের কাউন্টারে রয়েছে নানা উপহার সামগ্রী। রাতে থাকতে চাইলে, সেই আয়োজনও রয়েছে। কুঁড়ে ঘরের রোমাঞ্চও আছে, আবার চাইলে সেই কুঁড়ে ঘরের ভেতর বাতানুকূল যন্ত্রের ব্যবস্থাও রয়েছে।
মনে হতেই পারে, রিসর্টের ঢাক পেটাচ্ছি। না, ওই রিসর্টের কাউকেই চিনি না। তাদের বাণিজ্যিক প্রচারের কোনও দায় নেই। শুধু একদিন ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা, মুগ্ধতা মেলে ধরলাম। ভালটাকে ভাল বলতে বাধা কোথায়! এ তো গেল ঘেরা রিসর্টের কথা। এবার আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে খোলা জঙ্গল। যে কোনও একটা রাস্তা দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ুন। এমনিতে ভয়ের কিছু নেই। তবে গজরাজের কথা ভেবে একটু সাবধান থাকা ভাল। তাই সঙ্গে গাড়ি বা বাইক থাকলে নিরাপদ। কোন রাস্তাটা কোথায় যাচ্ছে, জানার দরকার নেই। যে কোনও মাটির রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়ুন। দু পাশে শাল, সেগুন, পলাশ, মহুলের ঘন জঙ্গল। মাঝে সরু রাস্তা। অদ্ভুত একটা গা ছমছম করা অনুভূতি। এভাবেই দেখতে পেলাম একটা ক্যানেল। সারা বছর জল থাকে না। কিন্তু বর্ষায় সেটাই যেন একটা নদী হয়ে যায়। ইচ্ছে করে সেই স্রোতে ভেসে যেতে। হঠাৎ কানে এল প্রবল জলের আওয়াজ। দেখলাম, অনেক ওপর থেকে জলপ্রপাতের মতো জল পড়ছে। চমৎকার দৃশ্য। বাঁকুড়ার নায়গ্রা মনে হতেই পারে।
পাশ দিয়ে যাচ্ছে একটা পিচের রাস্তা। শুনলাম, সেই রাস্তা দিয়ে তিন–চার কিলোমিটার গেলেই নাকি এয়ারপোর্ট। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। এই জয়পুরের ঘন জঙ্গলে এয়ারপোর্ট! ইয়ার্কি হচ্ছে! পরে আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। কী আশ্চর্য, তারাও একই কথা বলল। ঠিক শুনছি তো! মনে হল, এতটা যখন এসেছি, তখন আরেকটু যাওয়াই যায়। জঙ্গলের বুক চিরে এগিয়ে চললাম সেই এয়ারপোর্টের খোঁজে। এক বিস্ময় যেন অপেক্ষা করেছিল। জঙ্গলের মাঝে দীর্ঘ পথজুড়ে সিমেন্টের চাতাল। এটাই নাকি রানওয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জরুরিকালীন প্রয়োজনে বানানো হয়েছিল। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫–এই চার বছর নাকি এখানে বিমান ওঠা–নামা করত। যদিও যাত্রীবাহী বিমান নয়, সেই বিমানগুলিতে সেনাকর্মীরাই যাতায়াত করতেন। তারপর যুদ্ধ থেমে গেল। স্বাভাবিক নিয়মে সেই বিমানবন্দরও অবলুপ্ত হয়ে গেল। আস্তে আস্তে জঙ্গলে ঢাকাই পড়ে গেল। ভাবলেই অদ্ভুত এক শিহরণ হয়। এই জঙ্গলের মাঝে বিমান নামতো! এতবড় একটা সত্যি এতদিন জানতাম না! সত্যিই, বিপুলা এ বাঁকুড়ার কতটুকু জানি!
কীভাবে যাবেন?
যাঁরা কলকাতা বা অন্যান্য জেলা থেকে আসবেন, তাঁরা ট্রেনে বিষ্ণুপুর আসতে পারেন। সেখান থেকে গাড়িতে আধঘণ্টা। কলকাতা থেকে আরামবাগ হয়ে বাসেও আসতে পারেন।
কোথায় থাকবেন?
জয়পুরের বনলতা রিসর্টে থাকতে পারেন। ফোন নম্বর ৯৭৩২১১১৭০৬/ ০৩২৪৪ ২৪৯২৩৪ । এছাড়া বিষ্ণুপুরে অনেক হোটেল আছে। সেখান থেকেও ঘুরে আসতে পারেন।