পান্নার নাম প্রথম শুনেছিলাম ছেলেবেলায় ভূগোলের ক্লাসে। ভারতের সব থেকে বিখ্যাত, সত্যি বলতে কী একমাত্র প্রতিষ্ঠিত হীরের খনি পান্নায়। পরে শুনেছিলাম ওখানে জঙ্গল আছে। বাঘবন। প্রায় এক দশক আগে পান্না আবার যখন খবরে এল, তখন পান্নায় বাঘ আছে কুল্লে একটা, না থাকারই সামিল। সে আবার পুরুষ বাঘ। তাই আশপাশের টাইগার রিজার্ভ থেকে দু-দুটো পাত্রী এল তার। কিন্তু সেই সব পাত্রী দেখে পাত্র যে কোথায় পালাল সেটা জানা গেল না। তখন নতুন করে পাত্রও একটা আমদানি করতে হল। এর পরে বেশ কিছু দিন পান্নার খবর রাখিনি। বছর ছয়েক পরে আবার সুযোগ এল পান্না যাওয়ার। ১৯৮১ সাল থেকে পান্না জাতীয় উদ্যান, ১৯৯৪ থেকে প্রজেক্ট টাইগার-ও বটে। এখন বাঘ নাকি ৩০ ছাড়িয়ে গেছে। লোভ সামলানোর প্রশ্নই ওঠে না। ২০১৬ সালের এক পড়ন্ত বিকেলে হাওড়া থেকে ট্রেনে চাপলাম। প্রায় ১৭/১৮ ঘন্টার যাত্রা। রাত ১০টায় রওনা দিয়ে পরদিন বেলা ৩টে নাগাদ গিয়ে নামলাম সাতনা স্টেশনে। মাড়লা পৌঁছোতে বিকেল গড়িয়ে গেল। থাকার বন্দোবস্ত ওখানেই। পরদিন ভোরে সাফারি, তাই ব্যবস্থাপনা সেরে তাড়াতাড়ি শুতে গেলাম।
ভোরের আলো ফোটার আগেই অনেক লোকের ভিড় ঠেলে সাফারির টিকিট কাউন্টারে। এখান থেকে এবার সাফারি-গাইডের হেফাজতে। তাকে শুনিয়ে রাখলাম বাঘ না দেখলেও চলবে, ভাল্লুক, লেপার্ড কি বন-কুকুর দেখলে একই রকম খুশী হব। শুধু বাঘের পিছনে ধাওয়া করে অনেক ঠকেছি। গাইডরাও ভাবে বাঘ না দেখালে প্রেস্টিজ, বখশিশ দুটোই যাবে। মাঝখান থেকে পাগলের মতো বাঘের পিছনে ঘুরতে গিয়ে অন্য জীবজন্তু, অরণ্যপ্রকৃতি সব ফাঁকি পড়ে। নির্দিষ্ট সময় গেট পেরিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় ঢুকলাম। একটু একটু করে আলো যখন ফুটল, পান্নার জঙ্গলের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা। নীল নদী, ছোটো ছোটো জংলা পাহাড়, হালকা জঙ্গল আর বিশাল ঘাস ঢাকা প্রান্তরের পর প্রান্তর – পান্নাকে ভালোবেসে উঠতে সময় লাগেনি এতটুকু। যদিও ‘পান্না’ বলতেই আমাদের চেতনার রঙে যতটা সবুজ ভেসে ওঠে, পান্নার জঙ্গল ঠিক ততটা গভীর সবুজ নয়। অন্তত যে সময় আমরা গিয়েছিলাম তখন তো নয়ই। মনে রাখতে হবে তখন শীতকাল, মধ্যপ্রদেশের গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ তখনও পান্নার অবশিষ্ট সবুজটার উপরে লাঞ্ছনা করার অবকাশ পায়নি। তবু ততটা সবুজ যেন নয়। জঙ্গলের ফাঁকেফোকরে অনেকটা বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বড়োছোটো ঘাসবন। তৃণভূমির মরা হলুদ আর হালকা মরচে রঙের জমিতে সবুজের ছোপ কাটা উদার মুক্ত ল্যান্ডস্কেপ। এখানকার জঙ্গল মনকে আচ্ছন্ন করে না, বরং খোলামেলা খুশীতে মাতিয়ে তোলে।বেশি কষ্ট
করতে হল না, কপাল নেহাতই ভালো ছিল। দুটো সাফারিতে বাঘ দেখলাম তিন বার। একবার একসাথে তিনটে, একবার দুটো, আবার আলাদা করে একটা। গাইড অনুরোধ রেখেছিল। লেপার্ডও দেখলাম। ঘাসজঙ্গলের মধ্যে সেও ঘাসবন সেজেই বসে ছিল। কয়েক পা হেঁটে কোথায় যে মিলিয়ে গেল আর টিকিটিও দেখা গেল না তার। আমরা কিন্তু বাঘের থেকে তার পিছনেও কম সময় দিইনি।
পান্নায় তৃণভোজী প্রাণীর সংখ্যা কম নয়। যাকে বাঘের বা অপেক্ষাকৃত বড়ো মাংসাশী জন্তুদের শিকারযোগ্য প্রাণী হিসেবে ধরা হয়। যেমন নীলগাই আর চিতল প্রচুর, আকছারই চোখে পড়ে। সম্বরের সংখ্যাও যথেষ্ট। ইন্ডিয়ান গ্যাজেল বা চিঙ্কারা চোখে পরল বেশ কয়েকটা। শুনলাম চৌশিঙাও আছে। একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল গাইড, ড্রাইভার এরা বলল এখানে বার্কিং ডিয়ার নেই। ছোট্ট দুটো কয়েক ঘন্টার সাফারিতে আমাদের চোখে না পড়তেই পারে, কিন্তু ওরা দুজন তো এই জঙ্গলে সব সময় ঘোরে, এই অঞ্চলেই থাকে। ওদের অবিশ্বাস করার প্রশ্ন ওঠে না। খুবই অদ্ভুত বলতে হবে। বুনো শুয়োর আছে অনেক। একটা শেয়াল দেখলাম মরা নীলগাইয়ের দেহ থেকে মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছে। এরা স্ক্যাভেঞ্জার প্রাণী, জঙ্গল সাফ রাখাটাই এদের কাজ। আর দেখলাম বেশ ভালো সংখ্যায় শকুন। আজকে শকুন বোধহয় দেশে বাঘের থেকেও বেশী সংকটে আছে। এখানে একটা গভীর গিরিখাতের এক কোনায় একাধিক প্রজাতির বেশ কিছু শকুনের আড্ডা। জায়গাটার নাম ধুন্ধুয়া। বড়ো ভালো লাগে ওই গিরিখাতের গর্ত থেকে একের পর এক শকুনের গা ভাসিয়ে উপরে উঠে আসা।
আগেই লিখেছি পান্নার জঙ্গলে গাছপালার বাড়বাড়ন্ত তেমন নেই। সেগুনের বন আছে ছাড়া ছাড়া, তার সঙ্গে মহুয়া, কেন্দু, চিরঞ্জি, এমনধারা কিছু শুকনো পত্রমোচী গাছের জঙ্গল। বরং তৃণভূমিটাই আসল। তার মাঝে কেন্নদী কেউ যেন বালতি বালতি জলে নীল গুলে ঢেলে দিয়েছে। কাচের মতো নিস্তরঙ্গ স্থির জল। আশপাশের সবকিছুর উলটো হয়ে থাকা নিখুঁত, নিস্পন্দ প্রতিচ্ছবি। জলে জেগে থাকা পাথরে পাখির মেলা। স্টর্ক, বক, পানকৌড়ি জাতীয় পাখিই বেশী। খোলা মাঠে নজর করলেও বেশ কিছু পাখি দেখা যায়। ঘাসবনের ফাঁকে গুড়গুড় করে দৌড়ে পালায় বটের-এর পরিবার। নদী আর ঘাসবন ওরকম গায়ে গা লাগিয়ে এলিয়ে পড়ে থাকলে কী হবে, পুরো পটভূমিটা সবসময়েই জীবন্ত।
পান্নায় যাওয়া সহজ ট্রেনে সাতনা হয়ে। কলকাতা বা আশপাশ থেকে গেলে মুম্বাই মেল ভায়া এলাহাবাদ বা শিপ্রা এক্সপ্রেস-এর কথা ভাবা যেতে পারে। সাতনা থেকে পান্না শহর ৭৩ কিলোমিটার। সেখান থেকে পান্না টাইগার রিজার্ভের দুটো প্রবেশপথ হিনৌতা আর মাড়লা ভিন্ন পথে ১৯ কিমি আর ২০ কিমি। হিনৌতা আর মাড়লায় বনবিভাগের থাকার ব্যবস্থা আছে। মাড়লায় মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের। এ ছাড়া মাড়লার কাছাকাছি, পান্না শহরে আরও এপাশে ওপাশে বেশ কিছু প্রাইভেট হোটেল আর রিসর্টও আছে।
সাফারির সময় সকালে আর বিকেলে। সাফারির জন্যে অনলাইন বুকিং করা যায়, নয়তো ‘আগে-এলে-আগে-পাবে’ ভিত্তিতে বুকিং। মাড়লা আর হিনৌতা গেট দিয়ে প্রতিদিন প্রতি বেলায় নির্দিষ্ট সংখ্যায় সাফারির উপযোগী হুড-খোলা গাড়ি জঙ্গলে ঢোকে। সরকারি গাইড সঙ্গে নেওয়া বাধ্যতামূলক। বছরের বিভিন্ন ঋতু অনুসারে ভোর ৫.৩০ থেকে ৬.৩০-এর মধ্যে আর বিকেলে ১৪.৩০ থেকে ১৫.৩০-এর মধ্যে জঙ্গলের গেট খোলে।
পান্নায় বাঘের সংখ্যা, এখন এই ২০২০ সালে ৫০-এর আশপাশে।
যারা পান্না যাচ্ছেন তারা অবসর সময়ে, সাফারির ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে দেখে নিতে পারেন পান্ডব ফল্স, অজয়গড় দুর্গের অবশেষ, জাতীয় মিউজিয়াম আর পান্না শহরের দুই বিখ্যাত মন্দির প্রাণনাথজি ও বলদেবজি। দুটো মন্দিরের স্থাপত্যই ভিন্ন ধরনের আর মনে রাখার মতো। কেন্ নদীতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখতে ভালো লাগে। বিস্তারিত বিবরণ পেতে মধ্যপ্রদেশ পর্যটন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। মধ্যপ্রদেশ রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগম-এর কলকাতা অফিসের ঠিকানা আর যোগাযোগ: ‘চিত্রকূট’, রুম নং– ৬৭, সাততলা, ২৩০ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড, কলকাতা – ৭০০০২০; ফোন– ০৩৩-২২৮৩৩৫২৬, ইমেল– kolkata@mpstdc.com
পান্নার জঙ্গল সম্বন্ধে জানার জন্যে আর সাফারি বুকিং-এর জন্যে যোগাযোগ:
হিরের খনি দেখা যায়। কিন্তু সে জন্যে পান্না শহরে খনির অফিস থেকে বিশেষ অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
পান্নার জঙ্গলের সঙ্গে মাড়লা থেকে ২৫ কিমি দূরের খাজুরাহো আর রানে ফল্স ভ্রমণ-পরিকল্পনায় জুড়ে নিলে বেড়ানোটা আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।