গোয়া (Goa) বরাবরই আমার পছন্দের জায়গা। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, কোনওদিন সুযোগ পেলে ছাড়ব না। জানতাম খবরের কাগজে চাকরির সূত্রে সুযোগ একদিন আসবেই। আর হঠাৎই সুযোগটা এসে গিয়েছিল। অফিস থেকে বলল, ফুটবল টুর্ণামেন্ট কভার করতে যেতে হবে। টুর্ণামেন্ট শুরুর ছয় দিন আগে অর্থাৎ অন্ততঃ চারদিনের মাথায় পৌঁছতে হবে মারগাঁওয়ে (Madgaon)। কলকাতা থেকে ট্রেনে যেতেই তো দু’দিন, মুম্বাই (Mumbai) থেকে আবার বাসে এক রাত। তার মানে কাল বা পরশুর মধ্যে রওনা দিতেই হবে। যাওয়া আসা সব নিয়ে ২২ দিনের ট্যুর। গাড়ি ভাড়া, হোটেল, খাওয়া খরচ নিয়ে কত টাকা লাগতে পারে কোনও ধারনা নেই। অফিসের কাজে যাঁরা ঘন ঘন ট্যুর করেন তাঁরাও কোনও কিছু বলতে পারলেন না।
অফিসের ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ১২ হাজার টাকা তুললাম। সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত রেলের টিকিট বুকিং-এর রিজার্ভেশন করা যায়। তখনও হাতে ঘন্টা খানেক সময় ছিল। তখনও অন্য কাগজের থেকে কারা যাবে জানি না। জানলে একসঙ্গে টিকিটটা কাটা যেত। পরদিন রওনা হতে হবে জানিয়ে দরকারী কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা শিয়ালদায় গিয়ে টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম।।এরপর এর্মাজেন্সি কোটায় রিজার্ভেশন করানোটাই প্রথম চিন্তা। মুম্বাই মানে সাউথ ইর্স্টার্ন রেল। সুতরাং, দু’রাত শুয়ে যেতে হলে কাল সকালেই হয় নিউ কয়লাঘাট অথবা গার্ডেনরিচে গিয়ে ব্যবস্থা করতে হবে।
হাওড়া থেকে মুম্বাই যাবার প্রধান দুটি ট্রেন – গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেস এবং মুম্বাই মেল ভায়া নাগপুর। গীতাঞ্জলী ছাড়ে দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে।মহারাজ ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাসে (আগের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস বা ভিটি) পৌঁছনোর সময় রাত ৯টা ২০মিনিট। মুম্বাই মেল রাত ৮টায় ছেড়ে দু’রাত পরে ভোর ৫টা ২০মিনিটে পৌঁছোনোর সময়। গীতাঞ্জলীতে উঠে দেখা হয়ে গেল আরও দুই সহকর্মীর সঙ্গে। তাহলে আমি আর একা নই। নিজেকে কিছুটা চিন্তামুক্ত মনে হল। কারণ, ওই দু’জনের একজনের আবার আগেও মুম্বাইয়ে এসেছে। পরদিন রাত দশটার পর অর্থাৎ ৪০ মিনিট লেটে ছত্রপতি শিবাজী স্টেশনে নামলাম। আমরা প্রথমেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে হালকা কিছু রাতের খাবার খেতে খেতেই পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করে নিলাম। প্রথমেই আমাদের অভিজ্ঞ বন্ধুটি বলল, ‘সবচেয়ে ভাল হত, মুম্বাই মেলে এলে। গীতাঞ্জলীর থেকে ঘন্টা তিনেক বেশী সময় নেয় ঠিকই, কিন্তু এই রাতে নেমে হোটেলে ওঠার ঝামেলায় যেতে হত না। এখান থেকে গোয়ার বাস ছাড়ে বেলা ১১টার থেকে। পরপর বাস। কল্যান, দাদার থেকেও বুকিং হয়। সবাইকে তুলে নিয়ে এখানে আসবে। তারপর বলবে, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে নিন। এরপর বাসে ১২-১৩ ঘন্টা। মুম্বাই মেলে এসে সকালে নেমে রিটায়ারিং রুমের একটা ঘর নিয়ে নিলেই হত। সামান্য খরচ অথচ খুব ভাল ব্যাবস্থা।
মুম্বাইতে আমরা বেঙ্গল লজে উঠেছিলাম। বাঙালির সাধের এই লজ আর আগের মত নেই। হাত বদল হয়েছে। আরবের মালিক। ঘরগুলো ছোট হয়ে গেছে, ভাড়াও বেড়েছে বলে আমাদের বন্ধু জানাল। পরদিন আমাদের বেলা ১২টায় চেকআউট। সকালে টিকিট কেটে স্নান সেরে আমরা সাড়ে দশটার মধ্যে বেরিয়ে হেভি ব্রেকফাস্ট করলাম। এর মানে দুপুরে হালকা কিছু খেলেই হবে। দীর্ঘ বাস যাত্রায় আমিও এই পথেরই পথিক। বেলা ১২টায় বাসে ঊঠলাম।
কোথা থেকে গল্পে গল্পে রাতটা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। কিন্তু বেলার দিকে আর ভাল লাগছিল না। শেষ দিকে অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। গোয়ার মারগাঁওয়ে (Madgaon) পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল ৪টে হয়ে গেল। আমরা বাস থেকে গোয়া (Goa) সরকারের টুরিস্ট লজে উঠলাম। গোয়ায় (Goa) হোটেল ভাড়া অন্য অনেক জায়গা থেকে তুলনায় অনেক কম। এখানেও বেশী নয়। কিন্তু বেশ ভাল ব্যবস্থা। তবে পেছন দিকে একটা বড় মাছের পাইকারী বাজার থাকায় পূবের হাওয়ায় একটা গন্ধ চলে আসে।
গোয়ায় (Goa) মোটর বাইক ভাড়া নিয়ে আপনি দিব্যি কাজ কর্ম সেরে নিতে পারেন। শুধু ভাড়া জেনে নিয়ে বাইক চালকের পেছনের সিটে বসে পড়ুন। ফাতোর্দা স্টেডিয়ামে আমরা বাইকেই এলাম। পরদিন সকালে স্টেডিয়াম যাবার আগে সকালে গেলাম কোলাভা বিচ। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভীড় কম। কোনোরকম উপদ্রব নেই। বিচের ওপর দিয়ে যতদূর পারেন হাঁটুন। বিচে বসে আড্ডাও মারতে পারেন। আবার ক্রুইস রাইডিং-এর ব্যাবস্থাও আছে। সময় সুযোগ বুঝে সমুদ্র ক্রুইসে নেমে মাতোয়ারা হতে পারেন। এখানে বলে রাখা ভাল, প্রায়দিনই সকালে এই কোলাভা বিচের (Colva) অমোঘ ও দুর্নিবার আকর্ষণে হাজির হতাম। কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার ফিরে আসতাম। মনটা খুব ভাল হয়ে যেত। কয়েকদিন খেলা চলার পর একদিন আকস্মিকভাবেই সারা ভারত টেলিকম ধর্মঘট শুরু হয়ে গেল। সারাদিনের সংগ্রহ করা নানা খবর, ফুটবলের ম্যাচ রিপোর্ট কিছুই সেদিন পাঠাতে পারলাম না। এমন কি টেলেফোনও বিকল হয়ে গেল।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। খবর পাঠাবার আশায় স্টেডিয়ামে অনেকটা সময় অপেক্ষা করার ফলে রাতও হয়েছিল। হোটেল থেকে মাঠে খেলার দিন যাওয়া আসা করতে মিডিয়ার জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই গাড়ি অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। ভাড়ার বাইকও ঊধাও। অগত্যা আমরা বাংলা খবরের কাগজের যারা ছিলাম, হোটেলের পথে হাঁটতে শুরু করলাম। মাথার ওপর পূর্ণিমার চাঁদ। আর তখনই ‘বর্তমান’ পত্রিকার রুপায়ন ভট্টাচার্য (এখন এই সময় পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক) গাইতে শুরু করলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী মান্না দে’র গান- ‘ও চাঁদ সামলে রাখ জোছনাকে/কারও নজর তো লাগতে পারে/মেঘেদের উড়ো চিঠি উড়েও তো আসতে পারে/ও চাঁদ সামলে রাখ জোছনাকে’। তখনই ঠিক করলাম, আর যা হয় হোক, কাল আমি একদিনের সাউথ গোয়ার (South goa) প্যাকেজ ট্যুরে যাবই যাব।
টেলিকম ধর্মঘটের জন্য খবর পাঠানো যাবে না। মনে পড়ে গেল, এর আগে একবার কটকে টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ কভার করার ঘটনা। সকালে শুনলাম, ওড়িশার রুপকার গোপবন্ধু দাস প্রয়াত হয়েছেন, তাই প্রথম দিনের খেলা হবে না। সবাই পুরী গেল জগ্ননাথ দেব দর্শনে। আমি এবং আরও একজন ভাল খবরের আশায় থেকে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই পাইনি। মাঝখান থেকে পুরী মিস হয়েছিল। এবার আর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেব না। তার থেকে সাউথ গোয়া গিয়ে চাঁদ দেখাই ভাল। তবু আশঙ্কা ছিল, বাসের টিকিট পাব তো? তখনও মোবাইল ফোন বা ইণ্টারনেটের সুবিধা এই সময়ের মত ছিল না।
পরদিন সকাল দশটার মধ্যে কাউকে কিছু না বলে বিচ থেকে ফেরার সময়ে হোটেলের রিসেপশনে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সাউথ গোয়ার একদিনের প্যাকেজ ট্যুরের জন্য কোথায় গেলে আজকের টিকিট পাওয়া যেতে পারে? ওরা বলল, ‘আপনি আজ যেতে চাইলে টিকিট হবে, কিন্তু পেছনের দিকে’। আমি রাজি জানাতেই ওরা বলল, ‘স্যার, আপনি ইচ্ছা করলে এখনই টিকিট পেতে পারেন। বারোটায় হোটেলের সামনে থেকেই এসি বাস ছাড়বে। টিকিটের দাম ২৫০টাকা’। আমি তখনই টাকা মিটিয়ে দিলাম। ওরা টিকিটে বাসের নম্বর এবং সিট নম্বর লিখে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘হ্যাপি জার্নি স্যার’।
তবে প্যাকেজ ট্যুরের খরচ এখন বেড়ে ৩০০/৩৫০ হয়েছে। বাসে চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ বাস চলার পর সহযাত্রীরদের সঙ্গে আলাপ –পরিচয় হতে শুরু হল। গোয়ার (Goa) এই প্যাকেজ ট্যুরে একজন গাইড় থাকে। আমাদের গাইড় বয়সে যুবক। হঠাৎ বাসের ভেতর থেকে বলতে শুরু করে চালকের সামনে গিয়ে বলতে শুরু করলেন, আমরা নিরামার বিচে এসে পড়েছি। আসুন সকলে।
গাইড় বেশ হাসিখুশি, সকলের সঙ্গে মুখে হাসি নিয়েই উত্তর দিয়ে চলেছেন। গাড়ি থামল। এখানে নৌকা বিহারের সুযোগ আছে। আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ডলফিনও নাকি দেখতে পাওয়া যায়। এরপর ডোনাপাওলা বিচে চলুন। বিদেশীদের অন্যতম পছন্দের বিচ। আপনিও ঘুরে দেখুন, কাটান কিছু মুহূর্ত, ভাল লাগবে।এরপর দেখে নিন অসাধারণ স্থাপত্যর দু’টো গির্জা। আয়তনে সাধারণ মাপের চেয়ে বেশ বড়। সত্যি দু চোখ মেলে দেখার মত। এরপর প্রথমে শান্তা দুর্গা বিজয়ন্তে মন্দির দর্শনের পর মঙ্গেশ মন্দির দেখুন। পুজোও দিতে পারেন।
ইচ্ছা করলে পাশে থাকা বাজার থেকে গোয়ার কিছু ঐতিহাসিক স্মারক সংগ্রহ করতে পারেন। প্রিয়জনকে উপহার দিতে বেশ সস্তায় কেনাকাটাও সেরে নিতে পারেন। এখানে বাস অনেকক্ষণ দাঁড়ায়। মাঝখানে দুপুরের খাওয়ার ব্যাবস্থা প্যাকেজের লোকেরাই করে দেবে। গোয়ার খাবার বেশ সুস্বাদু, তবে একটু মশালাদার। এরপর দেখে নিন মান্ডভি নদীতে (Mandovi river) প্রায় ৬০০ মিটার উঁচু ওপরের ঝর্ণা, জল গড়িয়ে পড়ছে নদীতে। এখানেও আপনি ক্রুইজ রাইড করতে পারেন। এভাবেই একসময় বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামবে। ঐ সময় আপনার জন্য ‘ডলফিন সাফারি’র ব্যাবস্থা আছে। রাজি থাকলে আপনাকে পকেট থেকে আরও তিনশো টাকা গুনে দিতে হবে।
‘ডলফিন সাফারি’ (Dolphin safari) আপনার সারা জীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকতে পারে। তবে ডলফিন সাফারি আপনি নাও করতে পারেন। বাধ্যতামূলক নয়। এরপরই হোটেলে ফেরার পালা। বাস থেকে নামবেন অদ্ভূত এক মুগ্ধতা নিয়ে। ঘরে যাবেন মোহবিষ্ট হয়ে।
গোয়া (Goa) ভ্রমণের সেরা সময় নভেম্বর থেকে মার্চ। বিদেশী পর্যটকরা বেশী সংখ্যায় আসেন শীতের সময়। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত তাদের কাছে বড় প্রিয়। তবে অনেকেই প্রশ্ন করেন, নর্থ না সাউথ? গোয়ার কোন দিক বেশী দৃষ্টিনন্দন? আমার মতে গোয়ার দু দিকই ভাল। নর্থ গোয়ার (North Goa) গল্প তাই পরে একদিন শোনানো যাবে।