বছর তিনেক আগে একটা বাংলা ছবির পোস্টার দেখেছিলাম- মন যে করে উড়ু উড়ু। পোস্টারের কথাই
আমার মনের কথা। একবার ঘুরে এলেই যে উড়ু উড়ু ভাব কমে, এমন নয়। আবার কবে যাব বরং তার
অপেক্ষায় দিন গোনা।
আমার মতো অনেকেরেই পায়ের তলায় সর্ষে। লকডাইনের বাজারে এখনই হয়ত পুজোর ভ্রমণ নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। হয়ত, রাজস্থান বা সিমলার কথা ভাবছেন। কিন্তু যাঁদের ভিনরাজ্যে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, বা লম্বা ছুটি পাবেন না, তাঁদের জন্য বরং একটা জায়গার হদিশ দেওয়া যাক।
দূরে কোথাও নয়, এই বাংলাতেই। নিশ্চয়ই দার্জিলিং (Darjeeling)! না, তাও ঠিক নয়। তবে খুব কাছাকাছি। আর ভনিতা না করে বলেই ফেলি- তিনচুলে (Tinchuley)। যাঁরা বেড়ানোর ব্যাপারে খুব খোঁজ খবর রাখেন, তাঁরা হয়ত নামটা শুনেছেন। যাঁরা শোনেননি তাঁদের বলি, পর্যটন মানচিত্রে তিনচুলে (Tinchuley) তেমন বিখ্যাত নাম নয়।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, খরচ কীরকম? এসব কথায় পরে আসছি। তার আগে বরং যেনে নেওয়া যাক, তিনচুলে (Tinchuley) গিয়ে কী পাবেন? একেবারে নির্জন একটা পাহাড়ি গ্রাম। বিছানায় হেলান দিয়ে দেখুন সপারিষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা (Kanchanjunga)। কংক্রিটহীন জঙ্গলের স্নিগ্ধতা। সারাদিন পাখির কিচিরমিচির, সেই কলতানেই ঘুম ভাঙা। ছায়া সুনিবিড় পথে হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। সবচেয়ে বড় পাওনা সহজ সরল পাহাড়ি মানুষের আতিথেয়তা।
অনেকদিন ধরেই তিনচুলে (Tinchuley) যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু একসঙ্গে চারবন্ধুর সময়ের মিল হচ্ছিল না। এক একজনের এক একরকম সমস্যা। তাই যাওয়া আর হয়ে উঠছিল না। শেষমেশ বেরিয়ে পড়া গেল। আমি, আমার বাল্যবন্ধু সন্তু, স্কুলের সহ শিক্ষক দেবাশিস, আর ফটোগ্রাফার বন্ধু সঞ্জয়। প্রত্যেকেই কম-বেশী বর্ণময় চরিত্র।
প্রথমে ধরতে হবে শিলিগুড়িগামী (Siliguri) যে কোনও ট্রেন। কিন্তু কামরূপ ছাড়া কোনও ট্রেনের টিকিট পেলাম না। অগত্যা তাই সই। এন জে পি-তে একটু দেরিতে অর্থাৎ সাড়ে সাতটা নাগাদ নামলাম। তিনচুলেতে (Tinchuley) যাঁর বাড়িতে আমরা থাকব, সেই অভিরাজকে আগে থেকেই ফোনে বলা ছিল। সে বলেছিল, চাপ নেই, আমি স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে দেব। শুধু পাঠিয়ে দেওয়াই নয়, ড্রাইভারের ফোন নম্বর আমাদের, আর আমাদের ফোন নম্বর ড্রাইভারকে আগাম জানিয়েও রেখেছিল। মোবাইলের সুবাদে ড্রাইভার রাজা রাইকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হল না। তবে রাজাকে দেখেই আঁতকে উঠলাম। এ তো অবিকল বিমল গুরুংয়ের মত দেখতে!
বিপদে পড়লে বিমল গুরুংয়ের ভাই বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায় (তাতে অবশ্য বিপদ বেড়ে যেতে পারে)। রাজা রাইকে সেকথা বলতেই ওর মুখে চওড়া হাসি। কিন্তু হাসতে হাসতে শুরুতেই যা শোনালো, তাতেই আমাদের হাসি শুকিয়ে গেল। ভোরে আসার সময় নাকি তার গাড়ির সার্কিট পুড়ে গেছে। ফলে হর্ণ, আলো, ইন্ডিকেটর কিছুই কাজ করছে না। শুধু তাই নয়, না ঠেললে নাকি স্টার্টও হবে না। একে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা, তার উপর যদি গাড়ির ওই দশা হয়, তাহলে তো সর্বনাশ। রাজাভাই আশ্বস্ত করে বলল, ‘সোচিয়ে মাত, ভরসা রাখিয়ে’। ওর হাসিই বলে দিল, ওর ওপর ভরসা রাখাই যায়।
আমরা বললাম, কিছু তো খাওয়া হয়নি। একটা কোথাও দাঁড়িও। রাজাভাই হাঁ হাঁ করে উঠে বলল, ‘সাব, দাঁড়ালে কিন্তু আবার ঠেলা মারতে হবে। তবে তিস্তার ভয় নেই, তাই যে কোনও ঢালু জায়গা দেখে
দাঁড়ানোই যায়। সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন’। সেবক পেরিয়ে, তিস্তার পাশ দিয়ে এগিয়ে চললাম। ডান
দিকে উত্তাল তিস্তা। পাহাড়ি রাস্তায় এঁকে বেঁকে চলছে আমাদের গাড়ি। কালিঝোরায় গিয়ে রাজা ভাই থামল।
একসঙ্গে প্রাতরাশ হয়ে গেল। কালিঝোরা (Kalijhora) নানা কারনে বিখ্যাত। ‘অনুসন্ধান’ ছবির সময় এই কালিঝোরার বাংলোতেই দিন পনেরো ছিলেন অমিতাভ বচ্চন (Amitabh Bachchan)। বাইরের পর্যটকদের কাছে এই তথ্যটাও একটা ভাল বিজ্ঞাপন। এবার কালিঝোরা থেকে রওনা হলাম। তিস্তা বাজার ছাড়িয়ে গেলাম পেশকের দিকে। হাল্কা ঠান্ডা লাগছে। আমার পাশেই বেচারা দেবাশিস। আগের রাতে ট্রেনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই ওর ভীতি স্বাভাবিক। পেশক পেরোতেই গায়ে গরম জামা দিয়ে নিল। মোপচু আর তাগদা পেরোতেই বেশ ঠান্ডা। এই তাকদায় দারুণ একটা বাংলো হয়েছিল। হঠাৎ কী খেয়াল হল, গুরুংযের দলবল সেটা পুড়িয়ে দিল। এতে কার কী লাভ হল? গুরুংরা যদি বুঝত, তাহলে আর ভাবনা ছিল না।
তাকদার বুক চিরে গাড়ি ছুটল তিনচুলের (Tinchuley) দিকে। এই সুযোগে গ্রামে ঢোকার আগে রাজা ভাইয়ের ফোন নম্বরটা দিয়ে রাখা যাক- ৯৭৩৩১ ২৮২২৬। গ্রামে ঢুকতেই গুরুং গেস্ট হাউসের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল।
এই রে! এখানেও গুরুং! গুরুং বলতে তো ওই একটা মুখই মনে পড়ে। এই গেস্ট হাউসের নম্বর নেব নেব
করে আর নেওয়া হয়নি। আমাদের অভিরাজ ভান্ডারি অ্যাকোমোডেশনে। ফোন নম্বরটা চটপট লিখে নিন- ৯৭৪৯৩ ৭০৯৬৫। পাঁচটা ঘর। আমাদের জন্য দুটো আগাম রেখে দিয়েছিল অভিরাজ। ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা হলেও ঐ দিন প্রথম দেখলাম। বয়স তিরিশের মত।
মুখে হাসি লেগেই আছে। ট্যুরিস্ট নয়, যেন শহর থেকে আত্মীয় এসেছে। ওর মা, বাবা, দিদি, জামাইবাবুরাও আছেন। সবাই একসঙ্গে থাকে। অতিথিদের দায়িত্ব এই পরিবার নিজেদের হাতেই তুলে নেয়। আমাদের ঘরে বসিয়ে কে কী খাবে জেনে অভিরাজ চলল ব্যাবস্থা করতে। কী ভাবছেন, খুব খরচ? থাকার খরচ ঘরপিছু আটশো থেকে হাজার টাকা। সিজনে একটু বেশি। যা খুশি খান। মাথা পিছু সারাদিনে চারশো টাকার মত। সব দায়িত্ব অভিরাজের। আপনি মন দিয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করুন।
কিন্তু গ্রামের নাম তিনচুলে (Tinchuley) কেন? আগে তিনটি পাহাড় একসঙ্গে দেখা যেত। চুলে মানে চুলা বা ওভেন। এখন গাছপালা বেড়েছে, তাই কিছুটা ঢেকে গেছে। দূর থেকে মনে হতো তিনটি চুলা জ্বলছে। তাই নাম তিনচুলে। দার্জিলিং (Darjeeling) থেকে দূরত্ব মাত্র তিরিশ কিলোমিটার। নির্জন জায়গা। ছোট্ট জনপদে ভাল চাষবাস হয়।
ইকো ট্যুরিজিমের (eco tourism) দিকে ঝুঁকছেন এখানকার মানুষ। ওয়াইলডলাইফ ফেড়ারেশন (wildlife federation) থেকে নানা ব্যাপারে এই গ্রাম সাহায্য পায়। সানরাইজ পয়েন্টে হেঁটে যাওয়া যায়। অবশ্য গোটা গ্রামটাই ভিউ পয়েন্ট। বৈচিত্রময় সৌন্দর্য। আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা (Kanchanjunga) খুব একটা দুর্লভ নয়। ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা একেক সময় এক এক রঙে হাজির হবে। খুব কাছেই গুম্বদারা ভিউ পয়েন্ট। কালিম্পংও (Kalimpong) দূরে নয়। আরেকটু নিচের দিকে তাকালে পাহাড়ের বুক চিরে যেন চলে গেছে উত্তাল তিস্তা নদী। মনে পড়ে গেল শ্রীকান্তর সেই গানের কথা- ‘মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা’। কার মন যে কার জন্য ব্যাকুল! সেটাই তো বোঝা ভার।
শুধু স্নিগ্ধতা নয়। ছড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। গুম্বদারা রকের কথাই ধরুন। প্রায় দুশো বছর আগে
শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এখানেই নাকি লামারা আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশরাও এই রকে আসতেন।
এখানেই নাকি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ঘুরে আসতে পারেন বড় মাঙ্গোয়ায়, কমলালেবুর বাগানে। থরে থরে সাজানো কমলালেবু দু-একটা পাড়তে চাইলে কেউ বাধা দেবে না। এখানে কমলালেবু, স্কোয়াশ বা জ্যাম-জেলির কারখানা আছে। নিজের চোখে দেখে আসুন জ্যাম-জেলি কীভাবে হচ্ছে।
অফিসের ব্যাস্ততা তো সারাজীবন থাকবে। পরীক্ষার টেনসন, সংসারের নানা জটিলতা, সম্পর্কের
টানাপোড়েন- এগুলো থেকে কি মুক্তি আছে? আছে যদি সবকিছু ভুলে এই তিনচুলেতে আসেন। অজানা, অচেনা পাখির কুজন, দূরে শেতসুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিঁদুররাঙা আকাশ, হাতের সামনে সবুজ চা বাগানের উদ্দাম ঢেউ আপনাকে দু-দন্ড শান্তি দিয়ে যাবে। তাহলে আর বেশি ভেবে কাজ নেই। ফোন করুন অভিরাজকে।
আর সোজা চলে যান তিনচুলে (Tinchuley)।