শালের বনের মাথায় বাতাস দুলছে। সেই দুলুনিতে জোড়ায় জোড়ায় শাল পাতারা হাত ধরাধরি করে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। বসন্তের আগমনী বার্তা দিতেইযেন তাদের এই হুড়োহুড়ি। ফাগুনে বেলপাহাড়ীর (Belpahari) আশেপাশের অরণ্যে এই দৃশ্য সাধারণভাবেই নজর কাড়ে পথচারীদের।।
পশ্চিম মেদিনীপুরে (West Midnapur) অবস্থিত বেলপাহাড়ী (belpahari) আর আগের মত গন্ড গ্রাম নেই, সে এখন কলেবরে বেড়ে উঠে গঞ্জ-শহর। কিন্তু খানিক বাইরে গেলেই প্রকৃতি তার ওপর সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে উপস্থিত। ইন্দিরা চক থেকে যে রাস্তাটা ডানদিকে চলে গিয়েছে, সেই রাস্তাই আপনাকে পৌঁছে দেবে ঘাগড়া, কাঁকড়াঝোর হয়ে লালজল। পথে পরবে আমলাশোল, ঢাঙিকুসুম ঝর্ণা। মাঝে মাঝেই দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তর, গ্রাম বাংলা, ধান মাঠ, ছোট আদিবাসী গ্রাম আপনার মনকে উদাসী করবে।
আমরা উঠেছি বেলপাহাড়ী (Belpahari) বিডিও অফিস সংলগ্ন পঞ্চায়েত সমিতির গেস্ট হাউসে। থাকার ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো। কলকাতা থেকে চারটে বাইকে আমরা আটজন যখন বেলপাহাড়ী পৌঁছলাম, পশ্চিমের দিগন্তে তখন লাল রং ধরে গিয়েছে। অরুন তিওয়ারি আমাদের দেখিয়ে দিলেন আমাদের নির্দিষ্ট ঘরগুলোকে। ওনার তত্ত্বাবধানে এই পঞ্চায়েত সমিতির গেস্ট হাউসটা। বেলপাহাড়ীতে সব থেকে ভালো খাবার পাওয়া যায়, “কাঁচা লঙ্কা” রেঁস্তোরাতে। বিধান দেবনাথ এর কর্ণধার।
বিধান বাবু বেশ মিশুকে ও ভালো মানুষ। রানাঘাট এর লোক হলেও, কলকাতা থেকে স্নাতক হয়ে চাকরি করতেন। কিন্তু “বাঙালির ঘোড়ারোগে” আক্রান্ত হয়ে পড়েন। চলতে থাকে তার বোহেমিয়ান জীবন । শেষমেশ বছর তিনেক হলো পরিবার নিয়ে বেলপাহাড়ীতে স্থিতি। “ডুঙরি” নামক একটা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকও বটে উনি।
বেলপাহাড়ী (Belpahari) থেকে দেড় কিমি দূরে “আস্থাজুড়ি” গ্রাম। ঢোকার মুখেই দেখতে পাবেন লেখা আছে, “ওয়েলকাম টু হিস্টোরিক্যাল ভিলেজ”! তাম্র যুগের একদম শুরুর দিকে এই অঞ্চলে যে সমস্ত মানুষেরা থাকতেন, তাদের “অরিজিনাল ব্লাড ট্রেইল” এখনো বহন করে এই গ্রামের মানুষজন! ১৮৮৩ সালে তামার তৈরী কুঠার পাওয়া যায় এইখানে। অতুল শুরের “প্রাগৈতিহাসিক ভারত” বইয়ে এর আরো বিবরণ পাওয়া যায় যেখানে।
সকালের কাঁচা রোদে বাইক বাহিনী ধরেছে “ঢাঙিকুসুমের” রাস্তা। কালো ব্যাসল্টর ছেড়ে বাইক ধরে মেঠো পথ। সামান্য চড়াই-উৎরাই এর পর দুদিকে বর্ষীয়ান শালের অরণ্য, ফাঁকে ফাঁকে চিলতে রোদ নকশা কাটে অরণ্য শরীরে। ঢাঙিকুসুমের খানিক আগের থেকে শুরু হয় ছোট অথচ বেশ সুন্দর এক ট্রেকিং রুট ।ছোট ঝর্ণা হলেও চারপাশের পাথরে আকার নজর কাড়ে। নির্জন বনাঞ্চলের গভীরে তিরতির করে বয়ে চলেছে ঝর্ণা। জায়গাটা ভালো না লেগে উপায় নেই। প্রচুর পাখির ডাক আশেপাশের অরণ্যে, সন্ধের পরে বন্যজন্তুর আয়ত্তে চলে আসে এই অঞ্চল! তাই শেষ দুপুরের মধ্যেই ফিরে আশা প্রয়োজন এই ঝর্ণার থেকে।
কাঁকড়াঝোরে ঢোকার বেশ খানিক আগে থেকেই প্রকৃতি পাল্টাতে থাকে। ছোট ছোট বনাবৃত টিলা, তার পাদদেশ ঘেঁষে গ্রাম। দুইপাশে ধান কাটা রিক্ত মাঠ। কাঁকড়াঝোর আগের মতোই সুন্দর ! সরল আদিবাসী জীবন দিয়ে ঘেরা তার চারপাশ। কাঁকড়াঝোর ঢোকার মুখেই শ্রীকান্ত_লক্ষ্মীর, “লক্ষ্মীকান্ত ” হোটেল। সাদামাঠা অথচ আন্তরিকতায় ভরা। তাদের আথিতেয়তায় দুপুরে গরম মুরগির ঝোল ও মোটা চালের ভাতের কম্বো ছিল অফার অফ দি ডে!
যে রাস্তাটা নিচ থেকে পাহাড়ের পথ ধরলো পুরোনো বনবাংলার এখন CRPF ক্যাম্পের পাশ দিয়ে, সেটা স্বপ্নের রাস্তা! দুধারে ঘন মিশ্র বনাঞ্চল (শাল বেশি), মাঝ দিয়ে কালো চুলের ফিতে! পাখির ডাক ও ঝিঁঝিঁর কনসার্ট এ মুখরিত। এই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেই, “ময়ূরঝর্ণা হস্তী অভয়ারণ্য” হয়ে লালজল গুহা পৌঁছে ভোলাভেদা ছুঁয়ে আবার বেলপাহাড়ী (Belpahari)। ময়ূরঝর্ণা জঙ্গল শান্ত অথচ গম্ভীর। ছোট গ্রাম আছে, নিস্তব্ধ। দলমার দামালদের নিত্য আনাগোনা এই অঞ্চলে। দক্ষিণ বাংলাতে কাঁকড়াঝোরের অরণ্য সত্যি গভীরতায় ও প্রাচুর্যে অন্য মাত্রা আনে। “দলদলি” এই অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক গ্রাম! যোগাযোগ প্রায়বিচ্ছিন্ন ছিল আগে, এখন কিছুটা সম্ভব হয়েছে যোগাযোগের। কাঁকড়াঝোরের কিছু অঞ্চলে “petrified wood” ফসিল পাওয়া যায় । “ঘোড়াটিকা” নাম একজলাশয় আছে এই অঞ্চলে, যেখানে প্রাচীন মানুষের বসবাস ছিল!
“লালজল” যখন পৌঁছিলাম, বিকেল হয়ে গিয়েছে । ছোট টিলার উপরে গুহাটা। আগে এই গুহার নাম ছিল “দেওপাহাড়ের” গুহা। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো বেলপাহাড়ী ও তার আশেপাশে আরো চারটে গুহা আছে।
- ১) “রাজা-রানী” গুহা, বড়হাপাল এ
- ২) “গাররাসিনি” গুহা, গাররা সিনি পাহাড়ে
- ৩) “চাতলডুঙরি ” গুহা, গাররা সিনি পাহাড়ে
- ৪) “তামলিমাঙ” গুহা, তালপুকুরিয়া
সবকটা গুহার একটা বৈশিষ্ট হলো, প্রত্যেকটা গুহার মুখ হয় পূর্ব অথবা দক্ষিণ দিক করে, কারণ উত্তুরে হওয়ার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া শীতের সময়। মানুষ যখন গুহা নিবাসী ছিল, তখন তাদের কি দুর্দান্ত পরিবেশ ও স্থাপত্য বিদ্যা ছিল, সেটা শেখার এখনকার সমাজের! লালজলের গুহা দেখে নিচে নামার পর এক আদিবাসী দম্পতি কাঁচা শাল পাতায় খিচুড়ি প্রসাদ খাওয়ালো সামনের মন্দিরের, সাথে শাল পাতার দোনায় জল। সে আতিথেয়তা ভোলার নয়। কত সহজে বনগ্রামের মানুষেরা আপন করে নিতে পারে অচেনা মানুষদের! এটা শেখার আমাদের মত শহুরে দাম্ভিকদের।
বেলপাহাড়ী (Belpahari) থেকে গাররাসিনি পাহাড় ৭ কি মি। এই পাহাড়ের নিচে ব্রম্হশ্রী সত্যানন্দ সন্যাস আশ্রম আছে, ১৩৭৭ সালে স্থাপিত এই আশ্রম। এখানকার প্রসাদের বৈশিষ্ট হলো, কাঁঠাল বা জাম বা অন্য কোনো ফল প্রসাদে! পাহাড়ের উপরে গুহা আছে, বাতাসা দিয়ে পূজিত আরাধ্য ঈশ্বর। সুন্দর একটা জঙ্গল ট্রেক করে যেতে হয় এই গুহায়। পাহাড়ের মাথা থেকে দেখা যায় সুদূরের ঘাটশিলা শহর। আরো এক দ্রষ্টব্য জায়গা হলো, “খান্দারানী” লেক। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে ৪৫ কিমি দূরে, ও বেলপাহাড়ী থেকে ১০ কিমি দূরে এই লেকের অবস্থান। পরিযায়ী পাখির ভিড় থাকে শীতকালে। পারিপার্শিক সৌন্দর্য্য অসাধারণ!
সন্ধে নেমেছে বেলপাহাড়ীতে। বহু বর্ষজীবি মহীরুহের শরীর জুড়ে নেমে আসছে মাঘী পূর্ণিমার চাঁদ! আম ও শাল মঞ্জরীর গন্ধে মুখরিত চারপাশ। খুশিয়াল বাতাসে আনন্দের গান ভেসে বেড়ায় বাংলো চত্বরে। গল্পে, গানে সাথে অল্প পানে, সময় পার হয়ে যায়। আজ রাতে মুরগি কষার সাথে পাতলা হাতরুটি, সাথে স্যালাড।
আজ ফেরার দিন। চলে এসেছি “ঘাঘরা” তে। কাঁসাই নদীর এক শাখা বয়ে চলেছে অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে। বড় বড় পাথরের মধ্যে দিয়েতার গতিপথ। সেই পাথরগুলোর মধ্যে ছোট ছোট গর্ত তৈরী হয়ে ঘড়ার মত আকার নিয়েছে। সেই পাথরের খাঁজে বা ঘড়ার সারা বছর জল থাকে। তাতে ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙ, জল মাকড়শা দিয়ে ছোট বাস্তুতন্ত্র। দেখার মত। “ঘাঘরী” মানে ঘড়া, তার থেকেই ঘাঘরা। এটা কূরমালি ভাষা। এই অঞ্চলের কুর্মিরা “ঘাঘরাসিনী” মায়ের পুজো করে। সেই জন্য এই স্থান পবিত্র হিসাবে গণ্য আশেপাশের আদিবাসী পাড়ায়।
ঘাঘরা ছেড়ে বাইক ঝাড়গ্রামের (Jhargram) পথে । ঝাড়গ্রাম এখন শহর ! তবে বড় বড় গাছের উপস্থতি শহরের সৌন্দর্যে অন্য মাত্রা এনেছে । ঝাড়গ্রামের ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন। ১৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে আকবরের আদেশে রাজস্থান থেকে “সর্বেশ্বর সিংহ চৌহান” বাংলা জয় করতে আসে। “মল্ল” শাসকরা যে গভীর অরণ্যে বাসকরতেন এবং শাসন কার্য চালাতেন তা “ঝাড়িখন্ড” নামে পরিচিত ছিল। সর্বেশ্বর সিংহ এই অঞ্চলে আক্রমণ করে এবং মাল রাজাকে পরাজিত করে। জয়ী সর্বেশ্বর “মল্লদেব” উপাধি ধারণ করে এবং এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে। যার রাজধানী হয় ঝাড়গ্রাম (Jhargram)। প্রায় ৪০০ বছর ধরে ১৮জন রাজা এই রাজত্বে রাজকর্ম পরিচালনা করেছেন। ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে বিস্তৃত ঘাসজমি ও বাগান নিয়ে ঝাড়গ্রাম রাজপ্রাসাদ ইউরোপীয় ও মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের সংমিশ্রনে নির্মিত হয়। এখন এই রাজপ্রাসাদ সরকারি অতিথিশালা পর্যটকদের জন্য। ঝাড়গ্রামের মিনি চিড়িয়াখানাও দেখার মত! অপূর্ব এক শালের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চিড়িয়াখানা যাওয়ার রাস্তা।
ঝাড়গ্রাম থেকে চিল্কিগড় ৩১ কিমি রাস্তা। ২০ বছর আগের দেখা “কনকদুর্গা” মন্দির চত্বরের সাথে বর্তমানের ব্যবস্থাপনার আকাশপাতাল তফাৎ! আগে রহস্যময় ছিল, একটা ভাব বিরাজ করতো এখন অনেক সাজানো গোছানো। মন্দির যাওয়ার পথে এক চিলতে ঘন অরণ্য পড়ে! তাতে প্রচুর বনৌষধি গাছের সুন্দর করে নামকরণ করা। বর্তমান মন্দিরের পাশেই আদি মন্দির ও মনকামনা বৃক্ষ। পুরোনো মন্দিরের পাশ দিয়ে ছোট রাস্তা নিয়ে যাবে “ডুলুং” নদীর ধারে। তিরতির করে বয়ে চলা ডুলুং বর্ষাতে ভয়ঙ্কর! মন্দির সংলগ্ন স্থান ঘুরে “চিল্কিগড় ” রাজবাড়ী পৌঁছলাম। প্রায় ভগ্ন রাজপ্রাসাদ ইতিহাসের সাক্ষ বহন করেচলেছে। ঢোকার মুখেই বিশাল বটগাছ আর হনুমানের দল অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত। প্রধান রাজবাড়ীর ডানপাশে দূর্গা দালান ও সামনে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। এই নিয়েই চিল্কিগড়! দুর্গাদালানের মাথায় হালকা আলোয়, হনুমানের silhoutte সংসার! বেলাশেষের ফেরার পথে তারাই হাত নেড়ে বিদায় জানায়, রাজপরিবারের হয়ে।
NB: Arun Tiwari: +91 98300 33633. Kancha lanka: +91 89458 76719.