সবুজ ঘেরা পাহাড়ে নৈ:শব্দের মধ্যে শান্তি খুঁজতে আর কাজের চাপ থেকে মন সরিয়ে নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবো বলে গত বছর মে মাসের শেষের দিকে চলে গেলাম পেডং- এ (Pedong)। পেডং নাম শুনে ভাবতে বসলেন না কি জায়গাটা কোথায়? হ্যাঁ, জায়গাটা এখনও ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে তেমন জমে ওঠেনি। অফ বিট লোকেশনই বলা চলে। যদি গুগল জ্যাঠার স্মরণ নেন তাহলে তিনি বলবেন, পেডং কালিম্পং (Kalimpong) জেলায় পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা গ্রাম।
দিন পাঁচেকের ছুটি ছিল। ব্যাক্প্যাক বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য বৃষ্টি মাখা সবুজের সোঁদা গন্ধ মাখা পেডং। পেডং (Pedong) নামের মধ্যে গন্ধের কথা লুকিয়ে আছে। “পে” অর্থাৎ সুগন্ধী এবং “ডং” বা “দং” মানে বিশ্রামস্থল। সমতল থেকে ৪০৭০ ফুট (4070 ft) উঁচুতে এই গ্রাম। পেডং-এ যাওয়ার পথে মনের অনেক ইচ্ছে একসাথে পুর্ণ হয়ে গেল। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে এন জে পি নামার পর গোটা রাতের ট্রেন জার্নির ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। কারণ টয়ট্রেন।
এন জে পি থেকে যাত্রা শুরু করে সেই ট্রেন চলল দার্জিলিং (Darjeeling)।পথের দু’পাশের সবুজের সমারোহ, চা বাগান, নাম না জানা পাখি, অচেনা গাছের দল, জঙ্গল সব মিলিয়ে যেন একটা মায়া। সবচেয়ে উঁচু রেল স্টেশন ‘ঘুম’-এ (ghum) পা ছোঁয়ানোর সৌভাগ্যও হল। ঘুমে নেমে ভুলতে বসেছিলাম যে আমাকে পেডং যেতে হবে। ট্রেনের হুইশিলে সম্বিত ফিরতে দৌড়ে ট্রেনে চড়ে বসলাম।
ট্রেন এলো দার্জিলিংএ। বাঙালির চির ভালবাসার শহর। দার্জিলিংএ সময় কাটানোর ইচ্ছে ছিল। তবে হাতে সময় কম। তাই গাড়ি বুক করে চললাম কালিম্পং। কালিম্পং- এ একরাত কাটিয়ে শেয়ারের গাড়িতে যাব পেডং। কালিম্পং- এ যেতে লাগবে মোটামুটি আড়াই ঘন্টা। কালিম্পং পৌঁছে জিপ স্ট্যান্ড এর কাছে একটা হোটেলে রাতটা কাটালাম। এখানে ছোট বড় নানান হোটেল পাওয়া যায় পকেট এর রেস্ত অনুযায়ী। পরদিন ভোরবেলা উঠে রেডি হয়ে রাস্তায় এলাম। বেড়িয়ে এসে মনে হল, প্রকৃতি যেন হাসছে।
সেই মনোরম রোদ্দুর গায়ে মেখে তারপর বেরিয়ে পড়লাম পেডং-এর (Pedong) উদ্দ্যেশ্যে। শেয়ারের সুমোতে চড়ে বসলাম। ৩৫ থেকে ৪০ টাকা মোটামুটি জনপ্রতি ভাড়া। তবে ভাড়া সিজন অনুযায়ী বদলায়। কালিম্পং বাজার ছাড়াতেই সবুজ যেন আলিঙ্গন করল। চাপ্লাস গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগোতে থাকলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছলাম পেডং বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে আমার বুক করা হোম স্টের দূরত্ব প্রায় ৩ কিমি। গাড়ি বুক করব কিনা ভাবছি, এমন সময় ফোনে ভেসে উঠল জিগমে লাহ্ডেন এর নাম। যে হোম স্টে বুক করেছিলাম তার মালিক। ভাঙা হিন্দিতে জানতে চাইলেন- আমি কোথায়?
বললাম- বাসস্ট্যান্ড এ দাঁড়িয়ে আছি। কীভাবে আপনার বাড়ি পৌঁছব? ওপাশ থেকে খুব গম্ভীর গলায় ভেসে এল- বাসস্ট্যান্ড থেকে আমার বাড়ি পর্যন্ত একজন ফ্রি বাইক সার্ভিস দেয়। দেখুন যদি তাকে পান। এরপরই ফোন কেটে গেল। এ আবার কী ধরণের রসিকতা! মুহূর্তের মধ্যে একটা বাইক এসে পাশে এসে দাঁড়ালো। ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন- আপনি কি জিগমে লাহ্ডেন এর বাড়ি যেতে চান? আমি সেখান পর্যন্ত ফ্রি বাইক সার্ভিস দিই। অগত্যা উঠলাম। কিন্তু মনের মধ্যে প্র্শ্নের ঝড় উঠতে লাগল। কী ব্যাপার, কেন ফ্রি সার্ভিস দেন ইত্যাদি। হতভম্ব হওয়া যে তখনও বাকি আছে তা কী জানি। যাঁর বাইকে চড়ে এলাম তিনি বললেন, “হাই আমি জিগমে লাহ্ডেন।“ কী রসিকতাই না করলেন।।
যাই হোক, তারপর মোটামুটি ওনার বাইকের পেছনের সিটের অস্থায়ী সওয়ার হয়ে গেছিলাম আমি। আমার গাইড হওয়ার কাজটাও সানন্দে নিয়ে নিলেন নিজের ঘাড়ে। যাঁরা পরিবার নিয়ে যাবেন তাড়া গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। ছোট বড় নানান গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। দরদাম আপনার হাতে।
আমরা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরী পেডং-এর (pedong) রূপের মায়ায় মোহিত হতে। পেডং এর শেষ প্রান্তে ঋষি নদীর উপত্যকা (Rishikola on Rishi River)। এখানকার মানুষের বিশ্বাস অতীতে এখানে বসে কোনও ঋষি ধ্যান করেছেন। দুই দিক থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটি জলের ধারা। কিন্তু তারা নিস্তব্ধ।
চুপ করে প্রকৃতিকে উপভোগ করার আদর্শ জায়গা। পরের গন্তব্য আরেক উপত্যকা যার নামই সাইল্যাণ্ট ভ্যালি (Silent Valley)। বড় মায়াবী সবুজ মাখানো নিশ্চুপ এই উপত্যকা। পাইন গাছের জঙ্গলে মোড়া এই উপত্যকায় প্রকৃতি যেন নিজেই নিজের রূপে মুগ্ধ। কোনও কোলাহল নেই। প্রকৃতি ফিসফিসিয়ে নিজের গল্প শোনায়। অনেকে পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করেন। তবে আমরা চড়াই উৎরাই বেয়ে নেমে গিয়ে উপত্যকার কোলে দাঁড়িয়ে পাইনের গন্ধ মেখেছিলাম গায়ে।
এখান থেকে ট্রেক করে আমরা পৌঁছলাম তিনচুলে ভিউ পয়েন্টে। এখানকার সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায়না। পেডং- এর সবচেয়ে উঁচু জায়গা। যেদিকে তাকাচ্ছি প্রকৃতি নতুন নতুন রূপে ধরা দিচ্ছে। এখানে দাঁড়িয়ে দার্জিলিং,সিকিম শহর এবং ভুটান আর তিব্বতের (tibet) কিছুটা অংশেও উঁকি দেওয়া যায়। মেঘ যদি দৃষ্টি ঢেকে না দেয় অনেক দূরে নাথুলা আর জিলেপ লা গিরিপথ নজরে পড়বে। নিচের দিকে তাকালে ঘন জঙ্গলের মায়াবী রূপ মোহাবিষ্ট করে দেয়।
পরের দিন থুকপা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। থুকপা নুডলস এবং মাংস দিয়ে বানানো একটি পদ। জিগমে নিয়ে গেলেন কেজি ইহলাইন এ। পেডং-এর (pedong) তিনটি বৌদ্ধ গুম্ফা আছে। কেজি ইহলাইন সবচেয়ে প্রাচীন তাদের মধ্যে। ১৮৩২ সালে এটি নির্মিত হয়। গুম্ফার ভিতরের এবং বাইরের দেওয়ালের স্থাপত্য নানান গল্প বলে। বৌদ্ধ ধর্মের নানান নীতিকথা ছবির মাধ্যমে আছে। এই শিল্প মন কেড়ে নেবে। এবার গেলাম দামসাং দূর্গে (Damsang Fort)।
১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে এই দূর্গ তৈরি করেছিলেন এক অত্যাচারী ও অহঙ্কারী ভুটানি রাজা। এই দূর্গ প্রায় ধ্বংস হয় অ্যাংলো-ভুটানিজ যুদ্ধে ১৮৬৪ সালে। দামসাং থেকে চললাম রামিতে (Ramite dara)। মাত্রই ১০-১২ কিমির পথ। কিন্তু জলকাদা, ভাঙাচোরা রাস্তায় যেতে লাগল প্রায় দু ঘন্টা। কিন্তু তার জন্য না গেলে কি হয়? পেডং সুন্দরীর জড়োয়া গয়না যে সে নিজেই। অচিন পাহাড়ী গ্রাম এই রামিতে। ৬৪০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই গ্রাম যা দেখাবে, তা সারা জীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে।
রামিতে উঠে সামনে দেখলাম সুন্দরী কাঞ্চনজংঘা তার রূপের ডালি সাজিয়ে দাঁড়িয়েছে। আর নিচে তাকিয়ে দেখলাম বর্ষার আভাস পাওয়া তিস্তা নদীকে। ঘন্টাখানেক এ সৌন্দর্য উপভোগ করে ট্রেক করে পৌঁছে গেলাম সিলারি গাঁও (Sillery Gaon)। রামিতে থেকে সিলারি গাঁও এর দূরত্ব মাত্র ৩ কিমি। সিলারি গাঁও- এর মানুষজনের আতিথেয়তা তো মুগ্ধ করবেই সঙ্গে মুগ্ধ করবে পাহাড়ের কোলে সবুজ প্রকৃতির আতিথেয়তাও।
দুটো দিন যে কোথা দিয়ে বেরিয়ে গেল, খেয়ালই করতে পারিনি। জিগমের বাড়িতে যে কত নাম না জানা ভুটানি খাবার খেলাম তার মধ্যে জাশা মারু শাকাম দাত্শির (Jasha Maru) স্বাদ মুখে লেগে আছে। ভোরবেলা উঠলেই চায়ের টেবিলে আসতো কুকিজ আর সুজা। না সুজির পরিবারের লোক তো নয়ই এমন কি দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও নয়। ভুটানে মাখন দেওয়া চা অত্যন্ত জনপ্রিয়। তারই নাম সুজা। আপনি যদি সুরাপ্রেমী হন চেখে দেখতে পারেন ভুটানের ট্রাডিশনাল সুরা আরা। মাখন আর ডিমের সঙ্গে আরা জমে ভাল।
এত ভালোলাগা আর ভালবাসা যে ফিরতেই ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু ফিরতে তো হয়ই। আবার শেয়ারের গাড়ি চেপে রওনা দিলাম কালিম্পং। রাস্তায় পড়ে আলগারা (Algarah)। ইচ্ছে আর সময় থাকলে আলগারায় নেমে শেয়ারের জিপে চড়ে চলে যেতে পারেন লাভা (lava)। সেখান থেকে লোলেগাঁও (Lolegaon) ঘুরে শিলিগুড়ি (Siliguri) ফিরতে পারেন। সময় না থাকায় ইচ্ছে থাকলেও কালিম্পং ফিরতে হল। সেখান থেকে পুরনো পথে আবার কলকাতা। আবার কাজের ভিড়ে। তবে ওই ছোট্ট ট্যুরে সব চাপ সামলে নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে এসেছিলাম।
পেডং এ (pedong) গ্রামের সবুজ এর মধ্যে থাকতে চাইলে বেশ কয়েকটি হোম স্টে আছে। ব্যক্তি পিছু একদিনের ভাড়া 800 থেকে 1200 টাকার আশেপাশে। বুক করতে চাইলে ইন্টারনেটে বুক করতে পারেন। বা অফ সিজনে গেলে ওখানে গিয়েও বুক করতে পারেন। ঘোরার জন্য গাড়ি ও গাইডের ব্যবস্থা হোম স্টে থেকেই করে দেবে। ড্রাইভাররাই অনেকক্ষেত্রে গাইডের কাজ করেন। তবে আলাদাভাবেও সারাদিনের জন্য গাড়ি বুক করা যায়। সারাদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া মোটামুটি ২২০০-৩০০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে।