মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড়, সেই পাহাড় বেঁয়ে নেমে আসা ঝর্ণা, সেই ঝর্ণার পানিতে তৈরি হওয়া নদী – এসব মিলে বিছানাকান্দি (Bichanakandi) এক অনন্য প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বেশ সম্প্রতি জেগে উঠেছে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়সী – সবশ্রেণীর মানুষের কাছেই বিছানাকান্দি (Bichanakandi) অনেক পছন্দের একটি নাম। তাই যখনই ভ্রমণে যাওয়ার সুযোগ হয় তখনই সবার প্রথমে যে জায়গাগুলোর কথা মনে পড়ে তার মাঝে বিছানাকান্দি অন্যতম।
সিলেট (Sylhet) শহর থেকে খানিকদূরেই বিছানাকান্দির (Bichanakandi) অবস্থান। কয়েকজন বন্ধুকে জোগাড় করে আমরা রাতে বাসে ঢাকা থেকে চলে আসি সিলেটে। ভোরবেলায় সিলেট শহরে আমাদেরকে নামিয়ে দেয় বাসটি। সকালের নাস্তা করে আমরা এক ফাঁকে একটু শাহজালাল (রাঃ) এর মাজারে ঢুঁ মেরে আসি। বলে রাখা ভাল, বাংলাদেশের মাটিতে যত অলি-আওলিয়ারা এসেছিলেন তাঁদের মাঝে হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর নামডাকই সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায়। এজন্য তাঁর মাজারে সারা বছরই ভক্তদের ভিড় লেগে থাকে। এই মাজারে একবার ঘুরে আসলে ব্যাপারটি আপনার ভ্রমণে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে বাধ্য!
মাজার থেকে ফিরেই আমরা একটি লেগুনা ভাড়া করে নেই। এই লেগুনাতে করে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল সিলেটেরই গোয়াইনঘাটের হাদারপুর। এই রাস্তাটিও অনেক সুন্দর দেখতে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ, পরিবেশ দূষণ প্রায় নেই বললেই চলে। যতই আমরা গোয়াইনঘাটের দিকে এগুতে লাগলাম ততই মেঘালয়ের পাহাড়গুলো আমাদের সামনে স্পষ্ট হতে লাগলো।
হাদারপুর থেকে বিছানাকান্দি যাওয়ার জন্য এবার নৌকা ভাড়া করতে হয়। এই জায়গার নৌকাগুলো একদম অন্যরকম। বেশিরভাগ সময়েই এই নদীতে বেশ কম পানি থাকে। নৌকা যেন মাটিতে আটকে না যায় এজন্য সেগুলো বিশেষভাবে তৈরি। দামাদামি করে নৌকায় উঠতেই মাঝি ইঞ্জিন ছেড়ে দিলেন, আমরা এগিয়ে চললাম বিছানাকান্দির (Bichanakandi) দিকে।
বিছানাকান্দিতে (Bichanakandi) যাওয়ার এই নৌকাভ্রমণটি কিন্তু অনেক বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস। কারণ বিপরীত দিক থেকে যদি কোন নৌকা আসে তবে সেই ঢেউয়েই আমাদের নৌকাটা টালমাটাল হয়ে যাচ্ছিল। শুনলে ভয় লাগতে পারে তবে আসলে ভয়ের কিছুই নেই, কেননা বেশিরভাগ জায়গাতেই নদীর পানি অত্যন্ত কম। সরু এই নদী পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চলে গিয়েছে বিছানাকান্দি পর্যন্ত। নৌকার গলুইয়ে বসে পা ঝুলিয়ে প্রকৃতি দেখতে দেখতে এগিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটাই অন্যরকম!
দূর থেকে যখন প্রথমবারের মত বিছানাকান্দিকে (Bichanakandi) দেখি তখন বিস্ময়ে নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। সবার কথা জানিনা, তবে সুদূরে মেঘে ঢাকা ওই পাহাড়, তার বুক চিরে নেমে আসা ঝর্ণা আর সেই ঝর্ণার পানিতে তৈরি হওয়া অদ্ভুত সুন্দর এই নদীর দিকে তাকিয়ে পুরো জায়গাটিকে একদম স্বর্গের মতন মনে হচ্ছিল! নৌকা পাড়ে ভিড়তেই ছুট লাগালাম ঝর্ণার উৎসের দিকে।
মূল ঝর্ণাটি ভারতের সীমান্তের মধ্যে হওয়ায় অল্পের জন্য বাংলাদেশ থেকে ঝর্ণার একদম কাছে যাওয়ার উপায় নেই। ঝর্ণার পানি একদম বরফশীতল। অসম্ভব রকমের ঐ ঠান্ডা পানিতে আমরা সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বলে রাখা ভাল যে বিছানাকান্দির এই নদী পুরোটাই আসলে নানা রকমের পাথরের উপরে। অর্থাৎ পানির নিচে পা ফেললে সবই পাথর। ছোট বড় নানান সাইজের পাথরের জন্য জায়গাটিকে খানিকটা বিপদজনক বললেও ভুল হবেনা। তবে সাবধান থাকলে আপনি সম্পূর্ণ আনন্দটুকু উপভোগ করতে পারবেন।
বিছানাকান্দির (Bichanakandi) নদীটিতে স্রোত প্রচুর, সতর্ক না থাকলে এই স্রোত আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমি আবেগের আতিশয্যে চশমা পরেই নদীতে ডুব দিয়েই দেখি সুন্দর করে আমার চশমাটিকে পানির স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। একদম পরিস্কার সেই পানির নিচে ডুবসাঁতার কেটে অনেক খুঁজেও আর পেলাম না পছন্দের চশমাটিকে। যখনই আমি বিছানাকান্দি যাই তখনই এই নদীতে ডুবসাঁতার কাটা আমার অনেক বড় একটা শখের মধ্যেই পড়ে যায়। প্রায় তিন চার ঘন্টা বিছানাকান্দি থাকার পর আমরা আবার ফেরত আসি সিলেটের দিকে।
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও বিমান – তিনভাবেই আপনি সিলেট (Sylhet) পৌঁছাতে পারবেন। তবে খরচ ও স্বাচ্ছন্দ্যের দিক বিবেচনা করলে সড়কপথে ভ্রমণ করাই যুক্তিযুক্ত। রাতের বাসে ঢাকা থেকে রওনা দিলে সকালেই সিলেট পৌঁছে যাবেন। সিলেট থেকে লেগুনা ভাড়া করে চলে আসতে হবে গোয়াইনঘাটের হাদারপুরে। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করলেই পৌঁছে যাবেন বিছানাকান্দি।
এটি মূলত একদিনের ভ্রমণ তাই রাতে থাকার ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে হবেনা। তবে যদি চান তাহলে সিলেটে প্রচুর ঘোরার জায়গা আছে, একদুইদিন থেকে সবকিছু একবারে ঘুরে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে থাকার জন্য নানা মানের হোটেল বেশ সহজেই আপনি সিলেটে পেয়ে যাবেন। খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও সিলেট বেশ সমৃদ্ধ। যাই করুন না কেন, পাঁচভাই হোটেল আর পানসী হোটেলে একবেলা করে না খেয়ে সিলেট থেকে ফিরবেন না। আশা করি শুভ হবে আপনার বিছানাকান্দি (Bichanakandi) ভ্রমণ!