ঠান্ডার সময় অনেকেই ঠান্ডার দেশেই যান। আমারও মনে হয়েছিল, গরমকালে কয়েকদিনের জন্য ঠান্ডার জায়গায় ঘুরে ফের সেই তো অসহ্য গরমে ফিরে আসা! এই বায়ু পরিবর্তনে কী লাভ? এরপরই আমার স্ত্রীকে বললাম, চল এবার শীতে দার্জিলিঙে ঘুরে আসি। সে আঁতকে উঠে বলল, ‘ডিসেম্বরে দার্জিলিং, পাগল নাকি!’ অনেক বোঝানোর পর রাজি হল এবং শীতের শৈল শহর রীতিমত উপভোগও করল। সেবার দশ বছর পর বরফ পড়েছিল। যা উপরি পাওনা। ঐ সময়টা সিজন না হবার কারনে হোটেল ভাড়া অর্ধেক আর মানুষের ভীড়ও কম ছিল। এরপর হিমালয়ান car rally কভার করতে সড়ক পথে গিয়েছিলাম ওই ডিসেম্বরেই। টাইগারহিল-এ rally শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যে নেমেছিল। মনে আছে, কাঞ্চী(ওখানে পাহাড়ি মহিলাদের কাঞ্চী বলে সম্বোধন করা হয়) ভাঁড়ে চা ঢালতে ঢালতেই ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু এই বর্ষায় কোথায় যাওয়া যায়? ভেবে ঠিক করলাম, শান্তিনিকেতনে তো যাওয়া যেতেই পারে। ঘরের কাছে কম খরচে, অল্প সময়ে অনায়াসেই ঘুরে আসা যায়। কবিগুরুর সাম্রাজ্যের টান এতটাই অমোঘ যে অনেকেই বারবার যান। তবে বসন্ত উৎসব কিংবা পৌষ মেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়ের শান্তিনিকেতনে, আমার অভিজ্ঞতা মোটেই ভাল নয়। বছর তিনেক আগে শেষবার বসন্ত উৎসব দেখতে কলকাতা থেকে সড়কপথে আগের দিনই আমরা তিন বন্ধু প্রান্তিকের সোনারতরী(এক) আবাসনে উঠেছিলাম। আমাদের এক দাদা মাসের ১৫দিন ওখানেই থাকেন। একা মানুষ। সকাল থেকে গৌড় প্রাঙ্গনে বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠান। ঘরে বসে কিছক্ষণ গান শোনার পর বেরোলাম। আর তখনই শুরু তুমুল গোলমাল। শান্তির জায়গায় অশান্তি ভাল লাগে না। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে কলকাতার পথে। মনে আছে, বিকাল পাঁচটায় কলকাতায় ফিরে হোটেলে এসে দুপুরের খাওয়া সেরেছিলাম। এবারেও আমরা তিনজন। তবে ঠিক করলাম, সোনারতরী’তে নয়, হোটেলে উঠব।
দু’দিনের সফরে কবিতা, গান, প্রেম আর বৃষ্টি-বর্ষার শান্তিনিকেতন। কলকাতায় তখন মাঝে মাঝেই বৃষ্টি। বর্ষার বৃষ্টি যেমন হয়। কলকাতা থেকে মাত্র ১৬১ কিমি। হাওড়া থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়ার অনেক ট্রেন। শিয়ালদহ থেকেও ট্রেন পাওয়া যায়। মনে রাখবেন নামবেন কিন্তু প্রান্তিক স্টেশনে। ভুলেও বোলপুর নামবেন না। নামলে আপনাকে আবার টোটোতে উঠতে হবে। তবে দু’দিনের সফর হলে সকাল সকাল শান্তিনিকেতনে পৌঁছনই ভাল। খুব সকালে যেতে চাইলে ৬-০৫ মিনিটের গণদেবতা আছে। পৌনে ন’টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। এছাড়া ৭-১৫ মিনিটের জিয়াগঞ্জ ধরলে সোয়া এগারটায় নামবেন। তবে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৬-৩৫ মিনিটে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ৯-১০ নাগাদ পৌঁছয়। এরপর রামপুরহাট এক্সপ্রেস সকাল ৭-২০’তে ছেড়ে আপনাকে সাড়ে দশটা নাগাদ নামিয়ে দেবে। পৌনে তিন ঘন্টায় শান্তিনিকেতন। আমরা হাওড়া থেকে ৮-৩৫ মিনিটের সিউড়ি এক্সপ্রেসে গিয়েছিলাম। ৭ অথবা ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে। সেদিন ৭ থেকে ছেড়েছিল। পৌনে বারোটায় প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছে দেয়।
থাকবেন কোথায়? শান্তিনিকেতনে আছে অসংখ্য হোটেল ও রিসর্ট। হোম স্টে’ও পাবেন। এবার আর সোনারতরী নয়, উঠেছিলাম হোম স্টে’তে। স্টেশন থেকে একটা টোটো ভাড়া করে প্রথমেই আমরা কালোর খাবার হোটেলে গিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছিলাম। শান্তিনিকেতনে ‘কালো’র দোকান বিখ্যাত। যা চাইবেন পেয়ে যাবেন। জমিয়ে মাংস খেতে ইচ্ছা করছে, তো কাঁচা মাংস কিনে দিলেই ইচ্ছাপূরণ হবে। কালোর দোকানে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারার সময় এক ভদ্রলোক আমাদের তিনমূর্তিকে দেখে কৌতহল চেপে রাখতে না পেরে বললেন, ‘কলকাতা থেকে বোধহয়?’ আমরা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই প্রশ্ন, ‘তা ক’দিন থাকবেন, উঠছেন কোথায়?’ আমরা বললাম- দু’দিনের জন্য কোনও একটা হোটেলে উঠব, কাল সন্ধ্যাতেই তো চলে যাব। এবার উনি বললেন, ‘হোটেলে কেন, যদি চান তো হোম স্টে’তে উঠতে পারেন’ বলে জায়গাটা কোথায় বুঝিয়ে দিলেন। ওনার কথা মতো টোটো ছেড়ে দিয়ে আমরা হেঁটেই সেই হোম স্টে’তে পৌঁছে গেলাম।
ওখানকার মালিক নিপাট ভদ্রলোক। বললাম- আপনার হোম স্টে’র খবর কালোর দোকানে খেতে গিয়ে এক ভদ্রলোক দিলেন। উনি অবাক না হয়ে বললেন, ‘বুঝেছি দিবানাথবাবু। আগে কিছুদিন আমার হোম স্টে’তে থেকে গেছেন। বড় মনের মানুষ। এখন এক কামরার একটা বাড়িতে থাকেন। একা মানুষ, দিব্যি আছেন। এর আগে আপনাদের মত অনেককেই আমার এখানে পাঠিয়েছেন’। আমাদের ঘর দেখালেন। সত্যিই ভাল। উনি বললেন, ‘আপনাদের একটা রুম হলেই তো চলবে। তিনজন আছেন তো, আমার এই একটা রুমই ফাঁকা আছে। এক্সট্রা একটা বেড দিয়ে দিচ্ছি, হয়ে যাবে না’? বেশ বড় ঘর। ভাড়াও বেশি নয়, রাজি হয়ে গেলাম।
তারপর কোথায় গেলাম? কালোর দোকানেই শুনেছিলাম, প্রতি শনিবার সোনাঝুরিতে হাট বসে- হাটের নাম- ‘খোয়াই শনিবারের হাট’। স্নান সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শাল বনের সুশৃঙ্খল জঙ্গলের মধ্যে হাট। কতরকমের সব পন্য। নানা রঙের বৈচিত্রে শালবনকে অসাধারণ লাগছিল। আমি জানিনা, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এই হাটকে কী চোখে দেখেছিলেন? আর এক প্রকৃতি প্রেমিক বুদ্ধদেব গুহ তো শান্তিনিকেতনে বাড়িই কিনে ফেলেছিলেন। বুদ্ধবাবুর ছোট ভাই ইন্দ্রজিৎ গুহ (বাবুয়াদা)। দার্জিলিং-এর হিমালয়ান car rally থেকে ফেরার পথে আমাদের কয়েকজনকে ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার পর বাউল গানের ব্যাবস্থা করেছিলেন। পুরো একটা দিন আমাদের খুব আনন্দে কেটেছিল। যাই হোক, শনিবারের হাট-এর কথা বলতে গিয়ে অন্য কথায় চলে যাচ্ছি। হাটে আশপাশের গ্রাম থেকে যেমন আসে তেমনি, আহমেদপুর, দুবরাজপুর, সিউড়ি ইত্যাদি জায়গা থেকে ব্যাপারীরা আসেন। শাড়ি, কুর্তা, স্কার্ট, কতরকমের পোষাক, নানারকমের কুটির শিল্প, হ্যান্ডলুমের পসরা, এমনকি গহনা পর্যন্ত বিকোচ্ছে। কত মানুষ। অনেকেই দরদস্তুর করে কেনাকাটা সারছেন। ওখানেই আবার বাউলরাও আসেন। অনেকে শুয়ে বসে আছেন। আবার কেউ কেউ ঢোলের তালে নেচে নেচে গেয়ে চলেছেন। এ যেন দুর্গাপুজোর সময়ে শিয়ালদা বা হাওড়া স্টেশনের বাইরে ঢাকিদের মহড়া। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা সেদিন হোটেলে ফিরেছিলাম।
পরদিন সকালে প্রাতঃরাশটা ছিল একেবারে রবিবাসরীয়। আটার ফুলকো লুচির সঙ্গে নারকেল দিয়ে দুর্দান্ত সাদা আলুর তরকারি। অপূর্ব স্বাদ। সঙ্গে রসবড়া ছাড়াও সন্দেশ। গত রাতের খাবারটাও বেশ ভাল ছিল। কালকের মতো আজও পেতলের বাটি, গ্লাস ও থালা। এরপর হোম স্টে থেকে বেরিয়েই একটা টোটো নিয়ে যখন কোপাই নদীর দিকে যাচ্ছি, ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল। এখানে আসার পর কাল সারাদিন আকাশ গুমোট হয়ে থম মেরে ছিল। এই প্রথম বৃষ্টি। আমদের কবি বন্ধু দেবদাস গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল মান্না দে’র গান- “রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি/মাটির গায়ে গায়ে/ কী কথা লিখে যাও/শুধু তুমি, তুমি, তুমি, তুমি করে…। খুব ভিজতে ইচ্ছা করছিল।আমার অনুভবে এ যেন কিশোরী শান্তিনিকেতন। তার ভিজে মাটির গন্ধ মাখতে মাখতে আমরা বুদ্ধবিহার-এ পৌঁছলাম।
একটা ছোট ঘেরা জায়গায় বুদ্ধের বিশাল মূর্তি আমরা টোটোয় বসেই দেখে নিলাম। ওখান থেকে অমর কুটির-এ যখন পৌঁছলাম, তখনও টীপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। টোটো থেকে নেমে ভিজতে ভিজতেই গেলাম। খুব ভাল লাগছিল। কুটিরে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ছাড়াও চর্মজাত নানা জিনিষের সমাহার। বাটিকের কাজের রকমারি জিনিষ। কারখানায় সাদা কাপড় নিমেষে রঙ বদলে যাচ্ছে। তার ওপর হচ্ছে বাটিকের অসাধারন সব কাজ। নানা বস্ত্রের বৈচিত্রময় সংগ্রহ দেখা ছাড়াও শো রুম পাবেন। আছে অজস্র দোকান। ইচ্ছা করলে কেনাকাটাও করতে পারেন। আপনি পূর্বাঞ্চল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র শিল্প গ্রাম কমপ্লেক্স ঘুরে কিছূটা সময় কাটিয়ে আসতে পারেন। মন্দ লাগবে না। তবে ওখানে কোনও সবুজ পাবেন না।