রানি লক্ষী বাইয়ের নাম তো শুনেছেন। রানা প্রতাপের নামও শুনেছেন। কিন্তু রানি দুর্গাবতী? শুনেছেন নাম? তবে ইতিহাসের পড়ুয়ারা হয়ত জানতেও পারেন। গোন্ড বংশের এই রানির রাজত্ব ছিল আজকের জব্বলপুরে(Jabalpur)। ১৫৬৪ সালে মোঘল বাহিনী তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলে, রানি স্বয়ং হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে যুদ্ধে গমন করেছিলেন। তিন তিনবার শত্রুদের পিছু হটিয়ে দিলেও গলায় তীর বিঁধে আহত হন তিনি। পরাজয় নিশ্চিত বুঝে, বুকে ছুরি বসিয়ে আত্মহত্যা করেন। এবার সেই জব্বলপুরের(Jabalpur) কিছু টুকরো স্মৃতি।
কীভাবে যাবেনঃ হাওড়া থেকে জব্বলপুরে আসার মাত্র দুটো ট্রেন। আমি ও আমার এক সহকর্মী অফিসের একটা কাজে দু’দিনের জন্য ওই শহরে গিয়েছিলাম। এক বৃহস্পতিবার মুম্বাই মেল ভায়া এলাহাবাদ ট্রেনে রওনা হলাম। রাত দশটায় উঠে জব্বলপুরে(Jabalpur) নামার কথা পৌনে ছ’টায়। নামলাম প্রায় রাত ৮টায়। তার মানে দু’ঘন্টার ওপর লেট। মুম্বাই মেল ভায়া এলাহাবাদ(Allahabad) ট্রেন মানেই লেট। কিন্তু এত লেট! আসলে সবথেকে ভাল হতো শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস হলে। কিন্তু শক্তিপুঞ্জ যে দুপুর ১টার পর ছেড়ে যে রাত আড়াইটেতে পৌঁছয়। অচেনা জায়গায় অত রাতে? কোনও ঝুঁকি নিইনি।
কোথায় থাকবেনঃ আমরা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, দু’দিনের ট্যুরে রেলের রিটায়ার রুমে উঠব। না পেলে হোটেল তো আছেই। খুব সহজে রিটায়ার রুম পেয়েও গেলাম। বেশ বড় ঘর। সবরকমের সুবিধা। সবমিলিয়ে দারুণ ব্যাবস্থা। ভাড়া খুব কম, থাকা যায় ৪৮ঘন্টা, সঙ্গে অটুট নিরাপত্তা। স্টেশনে চা খেয়ে আমরা ঘরে যেতেই এক রেল কর্মী সাদা ধবধবে বেডকভার, বালিশ, কম্বল, জলের জার ও গ্লাস দিয়ে গেলেন। ওঃ বলতে ভুলে গেলাম একটা মশার লিকুইড তেলের মেশিনও লাগিয়ে দিয়ে গেলেন। সব মিলিয়ে আমরা অভিভূত। রাত দিনের ট্রেন জার্নির ধকল স্নান করার পর এক নিমেষে উধাও হয় গেল। একেবারে ফুরফুরে হয়ে আমরা বাইরে বেরোলাম। আসলে রাত হচ্ছে বলেই চিন্তা রাতের ভোজন নিয়ে। দুপুরের খাবার রেলের ছিল। ডিম বা চিকেনের মধ্যে আমাদের পছন্দ ছিল ডিম আর ভাত, সঙ্গে সব্জি বা ডাল ছিল। রেলের দেওয়া খাবার অনেকে সময় মুখে তোলা যায় না বলে যে জনশ্রুতি, সেই তুলনায় অতটা খারাপ নয়, মুখে তোলা গেছে। স্টেশনের বাইরে অনেক খাবার হোটেল। কিন্ত সবই নিরামিষ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা আমিষ হোটেল পাওয়া গেল। চিকেন, ডিমকারি পেলাম। শেষ পর্যন্ত চিকেন আর রুটি দিয়ে রাতের খাওয়া সারা হল। রাত বাড়ছে আর চোখ জুড়ে আসছে রাজ্যের ঘুমে। ঘরে এসে ঘুম, শুধুই ঘুম। ট্রেনের আওয়াজে সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গল। আমাদের প্ল্যান ছিল, স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ব। কাজ সেরে ফিরে যদি পারি তো বেরোব, না হলে পরের দিন যা যা দেখার দেখে রাতে ট্রেনে উঠব। সকালে আলুর পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম।
কী দেখবেনঃ
আমাদের কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে বিকাল ৫টা হয়ে গেল। একেবারে চা খেয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম ছাড়া আর তো কোনও কাজ নেই। পরিষ্কার পরিছন্ন চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে টেবিলের উলটো দিকে বসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। নিজেই বললেন, কলকাতা(Kolkata) থেকে বুঝি? তারপর সব শুনে বললেন, ‘এখানে যা দেখার আছে একদিনই যথেষ্ট। আর কে আপনাদের বলেছে, যে মারবেল রক দিয়ে দেখা শুরু করতে? আপানারা বরং সময় নষ্ট না করে ফ্রেশ হয়ে ‘কচনার সিটি’ দিয়ে শুরু করুন, মন ভাল হয়ে যাবে। ‘মারবেল রক’ কালকের জন্য রেখে দিন’। মনের মধ্যে তখন বারবার আমাদের এক সহকর্মীর কথাগুলো মনে পড়ছিল। যিনি বলেছিলেন, জব্বলপুরে অসংখ্য হোটেল। তারপর বলেছিলেন, কিন্তু মার্বেল রকের দৃশ্য সব থেকে ভাল দেখা যায় এম পি ট্যুরিজিমের হোটেল মার্বেল রকস থেকে। পূর্ণিমা রাতে জব্বলপুরের মার্বেল রক দেখার অনেকেই মুখিয়ে থাকেন। তাই ওই হোটেলে ঘর নাও পাওয়া যেতে পারে। সেখানে ঘর না পেলে নির্দ্বিধায় মাইকাল রিসর্টে থাকতে পার। এটিও মধ্যপ্রদেশ(Madhya Pradesh) পর্যটন দপ্তরের। জলের মধ্যে শ্বেতপাথরের পাহাড় না থাকলেও বহুদূরে জলাশয়কে ঘিরে রয়েছে নীল পর্বতশ্রেণী।
চায়ের দোকানে আলাপ হওয়া মানুষটি যে খারাপ বুদ্ধি দেন নি বুঝলাম ‘কচনার সিটি’তে যাওয়ার পর। অনেকটা রিসর্টের মতো জায়গা। তবে পর্যটকদের জন্য আদর্শ এখানকার শিবের মূর্তি। তখনই রাত আটটা। রাত ন’টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। মন্দিরের বাইরে চমৎকার আলোকসজ্জা। মন্দিরের ওপরে ৭৬ফুটের বিশাল শিবের মূর্তি। শিব এখানে বড়ই স্নিগ্ধ।
পরদিন দেখার ও ফেরার দিনঃ
ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। বারগি ড্যামের(Bargi Dam) একেবারে কাছেই রানি দুর্গাবতীর সমাধি। শত্রুর হাতে ধরা দেবেন না বলে, এখানেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তাঁর সমাধিস্থলের কাছেই সাজানো উদ্যান। রানি দুর্গাবতী ফোর্টের একেবারে পাশেই আছে ‘ব্যালেন্সিং রক’। বেশ অদ্ভূত এই রক। একটা বিরাট পাথরের ওপর আর একটি পাথর এমনভাবে রাখা যে মনে হবে একটু ছোঁয়া লাগলেই এখনই পড়ে যাবে। ঘুরতে ঘুরতে বেশ খিদে পাচ্ছিল। ঠিক করলাম, দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেওয়াই ভাল।
কী খাবেনঃ এখানে সারি সারি খাবারের হোটেলগুলো বেশ সাজানো গোছানো। আমাদের পছন্দ আমিষ। কিন্তু খোঁজাই সার। কোনও হোটেলেই আমিষ খুঁজে পেলাম না। অগত্যা নিরামিষ খাবার দিয়ে দুপুরের ভোজ সারতে হল। এখানে নিরামিষের সেরা পদ পনির। পনিরের নানা পদ। তবে নিরামিষ খাবারের রান্না বেশ ভাল। তৃপ্তি হয় খেয়ে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা জৈন মন্দির ‘পিষান হরি কি মদিয়া’তে না গিয়ে ‘মার্বেল রকস’ এর দিকে রওনা দিলাম। এখানে আর একটি আকর্ষণ ‘ধুয়াধার ফলস’। পুরোটাই নর্মদা(Narmada river) নদীর গতিপথ। মার্বেল রকস থেকে ধুঁয়াধার ফলস খুব একটা কাছে নয়। দুটো জায়গা দেখতে বেশ সময় লাগে। হাতে চার পাঁচ ঘন্টা সময় নিয়ে গেলে ভাল হয়। তবে আগে গেলাম ধুঁয়াধার।
অনেকে জব্বলপুর থেকে এসি গাড়ি ভাড়া করে সারাদিন ঘোরে। আমরা অটো ভাড়া করেছিলাম। সস্তা ও সুন্দর। দেখলাম ৩০০০টাকা খরচ করে এসি গাড়ি নেওয়া মানে বিলাসিতা। অটোয় পাঁচজন বসতে পারে। আমরা তো মাত্র দু’জন। আমরা কী চাই, সেকথা অটো চালককে প্রথমেই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। কমবয়সী যুবক। সবসময়ে মুখে হাসি লেগে আছে। বেড়াতে বেরিয়ে এরকম একজনকে পাওয়া মানে আমাদের চিন্তার ভার অনেকটাই লাঘব হয়ে যাওয়া। অটো প্রথমেই আমাদের ধুঁয়াধার ফলস-এর কাছে নিয়ে গেল। আমরা অটো থেকে নেমে জলপ্রপাতের দিকে রওনা দিলাম। হাঁটা পথে দশ মিনিট। দেখলাম ট্যুরিস্টদের বেশ ভাল ভীড়। মূল ফলসের কাছে রেলিঙের মতো করা। আমরা ওখানে না গিয়ে রোপওয়েতে গিয়ে উঠলাম। যাওয়া আসা মিলিয়ে ৯৫ টকার টিকিট। রোপওয়ে নর্মদা নদী পার করে দেয়। ওপার থেকে দেখতেও দারুন লাগে। রোপওয়ে থেকে নেমে এদিক ওদিক কিছুটা ঘুরে নিলাম। রোপওয়েতে যাওয়া আসা করতে মাত্র ১০মিনিট লাগে। অনেকের মনে হতেই পারে ‘ধুঁয়াধার’ নাম হল কেন? এখানে মূল জলপ্রপাতের জল এত জোরে পড়ে যে জায়গাটা ধোঁয়ার মতো হয়ে যায়। জায়গায় জায়গায় পাথরের মধ্যে দিয়ে জল বয়ে চলেছে। অসাধারণ প্রাকৃতিক শোভা। ধুঁয়াধার ফলস দেখে আবার রোপওয়ে ধরে ফিরে এলাম। এবার যাচ্ছি সেই বহু প্রতীক্ষার মারবেল রক দেখতে। অটো অপেক্ষা করছিল। মার্বেল রকসের প্রধান আকর্ষণ বোটিং। এটা করতেই হয়। তবে নদীতে জল না থাকলে বোটিং হয় না। সেজন্য সেপ্টেম্বরে বা তার পরে যাওয়াই ভাল। আধ ঘন্টার বোটিং ভাড়া মাথাপিছু ৫০ টাকা। এক ঘন্টার ভাড়া ১০০টাকা।
ছোট ছোট পাহাড়ের নধ্যে দিয়ে বোটিং। বেশ ভাল লাগছিল। বোটের হাল ধরেছিল যে জন, তিনি আবার গাইডের কাজও করে চলেছেন। হাল ধরে অনর্গল কথা বলে চলেছেন। প্রায় আধ ঘন্টা চলার পর আমরা সরু খাড়ির মতো একটা জায়গায় পৌঁছলাম। এখানে মার্বেল পাথর অনেকটা দু’পাশে উঁচু হয়ে উঠে গেছে। গাইড জানালেন, ‘মহেঞ্জোদারো’ ছবিতে হৃত্বিক রোশনের কুমীর হত্যার সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটার শ্যুটিং এখানেই হয়েছিল। অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম
এবার ঘরে ফেরার পালা। রিটায়ারিং রুমে যাওয়ার আগে স্টেশন থেকেই দু ভাঁড় চা খেয়ে নিলাম। ঘরে ছড়িয়ে থাকা জামাকাপড় আর টুকিটাকি জিনিষপত্রগুলো গুছিয়ে নিতে হবে। আলাদা করে স্টেশনে আসারও কোনও তাড়া নেই। কিন্তু ব্যাস্ততা আছে। রাত ১১-৫০ মিনিটে ট্রেন। এবার শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। লেট না করলে ভোর সাড়ে চারটেয় হাওড়া স্টেশন। আগেও এসেছি আবার আসব। তবে জব্বলপুরে হয়ত নয়, মধ্যপ্রেদেশের অন্য কোনও জায়গায়।