মেঘের ভেলায় বসে বক্সাদুয়ারের ইতিহাসের পাতায় পাতায় অনায়াসে বিচরণ করা যেত। যদি পুরনো বক্সাদুর্গের(Buxa fort) ঐতিহ্য সিঞ্চুলা(Sinchula) পর্বতশ্রেণীর মতো, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতো। পাহাড়ের সৌন্দর্য অম্লান থাকলেও বক্সাদুর্গের(Buxa fort) অস্তিত্ব লুপ্তপ্রায়। পড়ে আছে শুধু দুর্গের ভাঙা পাঁচিল ও কিছু রক্ত ঝরানো ইতিহাসের স্মৃতি। এত কথা জানতাম না, যদি জয়ন্তী(Jayanti) ভ্রমণের পাশাপাশি বক্সাদুর্গে(Buxa fort) ঘুরে আসার কথা না ভাবতাম।
আসলে পুজোর পরে আমাদের গন্তব্য ছিল জয়ন্তী। শিয়ালদহর(Sealdah) ৯বি প্ল্যাটফর্ম থেকে রাত সাড়ে সাতটার উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে উঠে পরদিন বেলা দশটার পর শেষ স্টেশন আলিপুরদুয়ার(Alipurduar) নামলাম। আগেভাগে গাড়ি বলা ছিল। সামান্য কিছু কেনাকাটা করে রাজাভাতখাওয়া(Rajabhatkhoa) হয়ে সোজা জয়ন্তীর সিইএসসি’র দোতলা কাঠের গেস্ট হাউসে। প্রতি তলায় দুটি করে বড় বড় ঘর, বাথরুম, রান্নাঘর(গ্যাস সমেত}, আর বিরাট চৌকাকৃতি বারান্দা। ঘরের খাটগুলো বেশ বড়। আর বসার বারান্দায় বেতের কয়েকটা চেয়ার ও সেণ্টার টেবিল। ২০১৪ সালে প্রতি ঘরের ভাড়া ছিল মাত্র ৬০টাকা। এখন হয়ত ভাড়া কিছু বেড়েছে। এই গেস্ট হাউস সিইএসসি’র ভবানীপুর অফিস থেকে বুক করতে হয়। গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকারকে বললে তিনি ও তাঁর মা অতিথিদের রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্ব হাসি মুখে নেন। ওখানে একটা খাবার হোটেলও আছে। অনেকে অবশ্য পৌঁছনোর পর প্রথম দিন অন্ততঃ একবেলা বাইরেই খেয়ে নেন। এছাড়া জয়ন্তীতে(Jayanti) দুটো সরকারী লজ ও সার্কিট হাউস আছে। জয়ন্তীতে(Jayanti) আমরা একজন গাইড নিয়েছিলাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর লেকে আমাদের মাছ দেখাতে নিয়ে গেলেন। ভাল কথা, ‘আমরা’ বলতে কারা বলাই হয়নি। আমরা মানে আমার কর্তা, আমি, আজকাল পত্রিকার দুই সাংবাদিক স্বরূপ গোস্বামী, তুষার প্রধান ও একটি বাংলা সাপ্তাহিকের নিনা বর্মন। আমি ছাড়া বাকিরা সংবাদমাধ্যমের। তুষারদার বাড়ি কোচবিহারে(Coachbihar)। আগে চলে গিয়ে আলিপুরদুয়ারে(Alipurduar) আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ঠিক ছিল, আমরা দু’দিন জয়ন্তী ও একদিন ভূটানের(Bhutan) ফ্রুন্ট সিলিং(Phuentsholing) ঘুরব। চতুর্থ দিন সকালে কোচবিহারে মদনমোহন-এর মন্দির দর্শন করে তুষারদার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া সেরে বিকালে আলিপুরদুয়ারে এসে কলকাতা(Kolkata) ফেরার ট্রেনে উঠব।
প্রথমদিন ট্রেন জার্নির ক্লান্তি নিয়েই আশেপাশের গ্রামে ঘুরে বেড়ালাম। প্রকৃতির মাঝে নিজেদের মেলে ধরলাম নানাভাবে। নীনা আর স্বরূপের গান একেবারে আমাদের সবাইকে মাতাল করে দিল
জয়ন্তীতে আমি আগে দু’বার এসেছি। এই নিয়ে চার বছরের মধ্যে তিনবার। দ্বিতীয় দিন আমাদের গাড়ি জঙ্গল সাফারিতে বেরোল। মনের ভেতর দারুণ উত্তেজনা। কিন্তু বাঘের দেখা না পেলেও লেপার্ডের দেখা পেলাম। হাতি ও হরিণ দেখতে পেয়েছি। আর লেপার্ডের গর্জনে জোড়া হরিণের ভীত সন্ত্রস্ত দৌড় দেখেছি। আর দেখা পেয়েছি গন্ডারের। বনবিভাগের কর্মীরা জঙ্গলের পথের দু’ধারে গন্ডারদের জন্য নুন রেখে দেন। নুন ওদের প্রিয় খাদ্য। আমাদের গাড়ি দূরে দাঁড় করানো হয়েছিল। গন্ডারদের নুন খাওয়া আমরাও বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলাম। ড্রাইভার আমাদের বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলছিলেন, ‘সাফারি চলাকালীন কোনও আওয়াজ করবেন না, আর কেউ সিগারেট খাবেন না’। এই গন্ধে জন্তু জানোয়াররা গা ঢাকা দেয়। ফেরার সময় দেখলাম জয়ন্তী নদীকে। জয়ন্তী নদী বহুদিন সংস্কার হয় না বলে বর্ষার পরেও জল গোড়ালি সমান। উত্তরবঙ্গর(North Bengal) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে অবশ্য কোনও কথা হবে না। একটা টাওয়ার আছে গেস্ট হাউসের সামনেই। টাওয়ারে উঠলে নাকি দূরের অনেক কিছু দেখা যায়। যার মধ্যে হাতি করিডর যেমন দেখা যায়, তেমনই দেখা যায় চোখ জুড়ানো চায়ের গালিচা। অনেকেই নাকি বলে ভুটান বর্ডারও নাকি টাওয়ারে উঠে দ্রেখতে পাওয়া যায়। তবে জয়ন্তীতে মোবাইলের লাইন পাওয়া খুব সমস্যার। কিন্তু ওখানকার টাওয়ারে উঠে আমাদের অনেকেই কলকাতার লাইন পেয়ে গেল।
সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে সবাই মিলে গল্প করার সময় তুষারদাই বলল, জয়ন্তী ঘোরা তো মোটামুটি ভালই হল। হাতে এখনো দু-দিন আছে। সক্কলে মিলে বক্সা(Buxa) থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়? তৃতীয়দিন সকালে আমরা পরোটার সঙ্গে আলুর তরকারি আর মিষ্টি সহযোগে ব্রেকফাস্ট করে বক্সাদুয়ারের দিকে রওনা দিলাম
বক্সাদুয়ার কীভাবে যাবেনঃ
আমরা যেখানে ছিলাম সেই জয়ন্তীর জঙ্গল ঘেঁষে শুরু হয়েছে পিচের রাস্তা। ওখান থেকে মাত্র ৫কিমি দূরে সানতালাবাড়ি(Santalabari)। আবার এই সানতালাবাড়ি(Santalabari) থেকে বক্সাদুয়ারের দুরত্ব মাত্র ৪ কিমি। অনেকটাই পায়ে হেঁটে উঠতে হবে। সমতল থেকে বক্সাদুর্গের উচ্চতা প্রায় ২৪০০ফুট। দুর্গের কাছে যেতে হলে আরও ১০০০ফুটের মতো পাহাড়ি খাড়াই পথ ধরে হাঁটতে হবে। কথায় আছে কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। গন্তব্যে পৌঁছনোর পর রেস্ট হাউসের বারান্দার সোফায় বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শোভা ও ফুরফুরে হাওয়ায় রাস্তার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। সোফায় বসে মনে হবে যেন দার্জিলিঙে(Darjeeling) বসে আছি। বক্সার পাহাড় সুন্দরীকে যেন প্রকৃতি অকৃপণভাবে সাজিয়েছে।
বক্সাঃ
১৯৩০ সাল। স্বৈরাচারী ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে চলছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। বিপ্লবীরা দেশকে স্বাধীন করতে মরীয়া লড়াই চালাচ্ছেন। আর এই আন্দোলনকে থামাতে ইংরেজ সরকারও নানা ফন্দী এঁটেছিল। তাদের মোক্ষম অস্ত্র ছিল দ্বীপান্তর। বাংলার বীর বিপ্লবীদের বন্দী করে তারা কাউকে পাঠিয়েছিল আন্দামানে(Andaman), আবার কারোর ঠিকানা হয়েছিল পাহাড়ের বক্সাদুয়ারে।
দ্বীপান্তরের যন্ত্রণার মত জোরদার করতেই যেন উত্তর-পূর্বে-সিঞ্চলা পর্বতশ্রেনীর দক্ষিণ কোলে আড়াই হাজার ফুট উঁচুতে, বক্সা সেনানিবাসকে বন্দিশিবিরে পরিণত করা হয়েছিল। শান্ত পাহাড়ের কোলে, মেঘে ঢাকা বন্দী শিবিরে লুকিয়ে আছে কত আত্মত্যাগের ইতিহাস। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ১৯৩০ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬। সময়টা বক্সা বন্দী শিবিরে ছিল বিপ্লবীদের তীর্থভূমি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বক্সার দুর্গকে বন্দিশালা হিসেবে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৬মার্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনী ঘোষনা করেছিলেন। সে সময় বক্সায় অনেক বামপন্থী নেতাদের আটক করে রাখা হয়েছিল। শান্ত পাহাড়ের কোলে থাকা লুপ্ত প্রায় পুরনো বক্সাদুর্গের বন্দী শিবির, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থানের সাক্ষী। এখানেই বন্দী ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সেই জেল জীবন নিয়ে দুরন্ত বই লিখেছিলেন- ‘মেঘের গায়ে জেলখানা’। বক্সার কত অজানা ইতিহাস রয়ে গেছে এই বইয়ে। বন্দিদশায় স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সৈনিকদের কলমেও শান্ত পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকা জেলখানার অনেক বিবরণ পাওয়া যায়।
স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে বক্সা দুর্গের বহু স্মৃতিবিজড়িত স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য, অতীতের রক্ত ঝরা সফলতা ও ব্যর্থতা এবং বিপ্লবীদের স্বপ্ন এবং আরও অনেক কিছুই আজ হারিয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর মহাড়ম্বরে বক্সায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ৫০ বছর উদযাপন হয়েছিল। যার মধ্যে পাওনা শুধু বিপ্লবী পুর্নেন্দু সেনগুপ্তকে দিয়ে একটি স্মারকস্তম্ভের উদ্বোধন। পাশাপাশি একটি সংগ্রহশালা। কিন্তু যে বন্দিশিবির নিয়ে গৌরবময় বিপ্লবের ইতিহাস তা সংরক্ষণের কোনও পদক্ষেপের বদলে দেখা গেল উদাসীনতার ছবি। একদিকে বিলুপ্তির হাতছানি। অন্যদিকে, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। দুই’য়ের টানাপোড়েনে কোনটা এগিয়ে থাকবে তা সময়ই বলবে।
বক্সাদুর্গ দেখে আবার জয়ন্তীতে ফিরে এলাম। ভরা ক্লান্তি। এবার আর ভুটানের ফ্রুন্ট সিলিং যাওয়া হল না। আগামীকাল সকাল সকাল উঠে কোচবিহার রওনা হতে হবে।
মদনমোহন মন্দির(Madanmohan Temple) দর্শন করে তুষার প্রধানের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া পর্ব মিটিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে উঠে বসা। আর দারুণ একটা বেড়ানোর স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফেরা।