সেবার উত্তরবঙ্গ থেকে ফোন করে বন্ধু রাজকুমার বেশ নাটকীয়ভাবে বলল, শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘মেঘ এখানে গাভীর মতো চরে বেড়ায়’। আমি বললাম, সকালেবেলাতেই নেশা টেশা করেছ না কি, ভুলভাল বকছো? রাজকুমার একচোট হেসে বলল, ‘উত্তরবঙ্গের ঝান্ডি’তে এলে আপনার এরকমটাই মনে হতে পারে। চলে আসুন ঝান্ডি যাব’। এরপর হেঁয়ালি করে বলল, তবে শিলঙের মেঘের মতো ঝান্ডির মেঘ ক্ষণে ক্ষনে বৃষ্টি ঝরায় না। এর আগে আপনাকে একরকম জোর করে একবার লক্ষীপুজোর পর টোটো পাড়া নিয়ে গিয়েছিলাম। তখন বলেছিলেন, ঝান্ডি হলে হতো। এবার চলে আসুন, চলে আসুন’। এই আহ্বান ছিল আমার থেকে বয়সে কুড়ি বছরের ছোট ডাঃ রাজকুমার সাহার।
এই প্রসঙ্গে রাজকুমারের সম্পর্কে একটু বলে নিই। নদীয়ার গয়েশপুরের ছেলে। পেশায় ডাক্তার। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করার পর অস্থি বিশেষজ্ঞ হন। ছাত্রজীবনে নানা বামপন্থী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। আদর্শবাদী। ডাকাবুকো এবং আমুদে স্বভাবের রাজকুমারের আর একটা গুণ গোপনে বহু মানুষকে নানাভাবে সাহায্য করা। হাওড়ার উদয়নারায়নপুর হেলথ সেন্টারে চাকরির সময়ে পরিচয়। পরে পারিবারিক বন্ধু। এখন পোস্টিং জলপাইগুড়ির বীরপাড়া হাসপাতালে, থাকে শিলিগুড়ি।
ঝান্ডিদারায় প্রথম দিনঃ
উত্তরবঙ্গ আমার দ্বিতীয় পৃথিবী। এবারেও সেই লক্ষী পুজোর পর। ওই সময়টা হাতে তেমন কোনও কাজও ছিল না। পাঁচ-ছ’দিনের অবকাশে ঘুরে আসা যেতেই পারে ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হল, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে ধুপগুড়ি স্টেশনে নেমে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াব, রাজকুমার ওর গাড়ি নিয়ে ওখানে অপেক্ষা করবে। ধুপগুড়ি থেকেই ডুয়ার্স শুরু। জলপাইগুড়ির পর ধুপগুড়ি স্টেশনে ট্রেন ঢুকল সকাল ৯টা নাগাদ। অর্থাৎ প্রায় ৪৫মিনিট লেটে। রাজকুমার অপেক্ষা করছিল। বলল, ‘ট্রেন লেট তো’। লাগেজটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিজেই গাড়ির গাড়ির পেছনের সিটে রাখতে রাখতে বলল, ‘গরম পোষাক দু’একটা নিয়ে এসেছেন তো, এখানে কিন্তু ভাল ঠান্ডা পড়ে গেছে। আর ঝান্ডিতে তো আরও ঠান্ডা’। এরপর বলল, ‘দাদা রাতে ট্রেনে ঠান্ডার মধ্যে নিশ্চয়ই ভাল ঘুম হয়নি? আগে চা খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে নেবেন চলুন’।
গাড়িতে উঠে রাজকুমার বলল, ‘শিলিগুড়ির বাড়িতে শনিবার বিকালে গিয়ে সোম অথবা মঙ্গলবার চলে আসি। সব সপ্তাহে আবার যেতেও পারিনা। তবে আগের মতো এখন আর ইচ্ছমত এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়তে পারি না। সাংসারিক দায়বদ্ধতা অনেক বেড়ে গেছে। তবে, কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছিল, কাছে পিঠে দু’তিনদিনের জন্য কোথাও ঘুরে এলে মন্দ হয় না। আর তখনই আপনার কথা মনে হল। কলকাতায় না গেলে আপনাদের সঙ্গে দেখাই তো হয় না। আর দেখা হয় আপনারা এলে’। একটানা কথাগুলো বলে রাজকুমার থামল। এভাবেই গল্প করতে করতে আমরা একসময় মালবাজার এসে গেলাম।
মনে পড়ে গেল, এর আগে মালবাজারে একবার ‘বিরসা মুন্ডা দিবস’-এর অনুষ্ঠান উপলক্ষে সাংসদ মনোহর টিরকের আমন্ত্রণে আমি এবং আরও দুই সাংবাদিক এসেছিলাম। সালটা ছিল ২০১২। মঞ্চে সাঁওতালীরা আমাদের যেভাবে সম্মানিত করেছিলেন তা কোনওদিন ভুলব না। মনে আছে নিজের হাতে সাঁওতালী নারীরা আমাদের মাংস রান্না করে খাইয়েছিলেন। কী অসাধারণ স্বাদ। পরদিন মঞ্চে সাঁওতালী মেয়েদের সঙ্গে নাচতে হবে শুনে কোনও রকমে পালিয়ে বেঁচেছিলাম। ওঁদের অকৃত্তিম আন্তরিকতার কথা সারাজীবন চেষ্টা করলেও ভুলতে পারব না। আমরা মালবাজার থেকে বিস্কুট, চানাচুর জাতীয় কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা করে নিলাম। এখান থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে গেলেই ঝান্ডির ইকো হাট। ওখানেই আমরা থাকব। জায়গাটা গরুবাথান ব্লকের আপার লুংসেল গ্রাম। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬০০০ ফুট উঁচু।
যাবার রাস্তাটাও দারুণ। ঘন সবুজের বুক চিরে বয়ে চলা যেন ষোড়শী নদী। মীনা গ্রাস চা বাগান। আর সেই নয়নাভিরাম মখমলের গালিচার মতো উপত্যকা। এই সব পেরিয়ে তবে প্রকৃতির স্বর্গ রাজ্যে পৌঁছনো যায়। অপার শান্তির জায়গা। চারিদিকে পাঁচ রঙা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সারি সারি পতাকা পতপত করে উড়ছে। এই ছবি যেদিকে এবং যতদূর চোখ যায় দৃশ্যমান। যেন, সব মানুষকে মুক্তমনে মানবতা,শান্তি ও অহিংসার বানীতে স্নান করাতে চাইছে। যেন আনতে চাইছে ‘দীপঙ্কর স্তুপ’এর ছায়াতলে। ওই স্তুপ ছাড়িয়ে পাকদন্ডী পথ ঘুরে গাড়ি আরও উপরে উঠতেই নিচে ধরা দিল, অপার সৌন্দর্যের লাস্যময়ী রানি ডুয়ার্স।
এভাবেই গাড়ি যত এগোচ্ছে ততই যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। আর এই ঘোরের মধ্যেই রাজকুমার ইকো হাটের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল। আগেভাগে সব ব্যবস্থা করেই এসেছে। আমি বসে থাকলাম। আর রাজকুমার গাড়ি থেকে নেমে রিসেপশনে গিয়ে কথা বলে এসে বলল, ‘আমাদের লাগেজগুলো নিয়ে নেমে আসুন, আমি গাড়িটা ভেতরে পার্ক করে দিই’। গাড়ি থেকে নেমে ইকো হাটের চারিদিকে তাকিয়ে সততই চমকে গেলাম। মনে হল, ডুয়ার্সে নয়, ছবিতে দেখা যেন ইউরোপের কোনও দেশে চলে এসেছি। পাহাড়ের খাঁজ কেটে প্রতিটা কটেজ একেবারে ব্রিটিশ স্টাইলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যমণি হাওয়া মহল ভিউ পয়েন্ট। কটেজগুলির উত্তর দক্ষিণ সব খোলা। দিনের বেলা এখানে দাঁড়ালে ডুয়ার্সের নদী আর বনাঞ্চল স্পষ্ট দেখা যায়। লাভা, আলাগারা ও কালিম্পং দেখা যায়। মনে হচ্ছে শৃঙ্গের উপরে দাঁড়িয়ে মনমাতাল হচ্ছি। নিচে বরফগলা জল নিয়ে বয়ে চলেছে মূর্তি, লিস, ঘিস নদীরা।
দুপুরে কটেজের খাবারটা বেশ ভাল ছিল। সবরকমের খাবার, এমনকি কন্টিনেন্টালও পাওয়া যায়। এখানে বেশ কয়েকজন বিদেশীকে দেখেছি। তাদের কথা ভেবেই বোধহয় কন্টিনেন্টালের ব্যবস্থা। আমরা অবশ্য ডাল, ভাত, ভাজি আর মুরগির ঝোল দিয়ে খাওয়া সেরেছি। বিকালের পর থেকেই ঠান্ডা যে জাঁকিয়ে পড়বে, এমন আভাস পাচ্ছিলাম। কটেজের ঘরে বসেই সোয়েটারের ওপর শাল চাপিয়েছি। সন্ধ্যা একটু ঘন হতেই আমাদের অর্ডার করা মুরগির রোস্ট চলে এল। সঙ্গে হাল্কা তরল পানীয় রাজকুমার মালবাজার থেকেই নিয়েছিল। ঘর থেকে চেয়ার টেনে নিয়ে ব্যালকনিতে জমিয়ে বসলাম। একদিকে আকাশচুম্বী পাহাড় অন্যদিকে আমরা। সঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা তার সঙ্গে এই কিছুক্ষনের অন্তহীন আমেজ একাকার হয়ে গেল। সহসা, মান্না দে আমার ওপর ভর করলেন। আবেগে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলাম, ‘মেজাজটা যে আসল রাজা, আমি রাজা নয়….’। রাজকুমার বলল, ‘দাদা, ঠান্ডা লেগে যাবে, এবার ঘরে যাই চলুন’।
দ্বিতীয় দিনঃ
রাতে ঘুমটা ভালই হল। হয়ত আরও কিছুক্ষণ ঘুমোতাম। কিন্তু ভোর পাঁচটার আগেই পাখির বৈচিত্রময় ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। রাজকুমার বলল, ‘আমরা কি কটেজে শুয়ে থাকতে এসেছি! চলুন বাইরে বেরোই, সূর্যোদয় দেখে এসে চা খাব’। তখন অন্ধকার। তৈরি হতে হতে আকাশের বুক চিরে আলো ফুটতে শুরু করল। সূর্যোদয় দেখার জন্য অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। মন মাতানো ইকো হাটের ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে ‘কর্ণ পিতা’র উদয় দেখা যায়। অনেকেই দেখলাম একে একে রঙবেরঙের শীত পোষাক পরে কটেজের ব্যালকনিতে এসে হাজির হচ্ছে। এক অপূর্ব দৃশ্য। শীতেই তো নিজেকে সাজাবার মরশুম। এমন সময় আবার চমক। ট্রে-তে চা-এর পেয়ালা সাজিয়ে নিয়ে কটেজের কর্মীরা হাজির। আমাদের কাছে একজন এসে হেসে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘গুডমর্নিং স্যার’। আমরাও তাঁকে গুডমর্নিং জানালাম। আঃ, গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সূর্যোদয় আর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব কোনওদিন স্বপ্নেও কি ভেবেছি! দেখার মেজাজটা লেখায় বর্ণনা করতে পারছি না। এ শুধু অনুভবের।
ইকো হাটে অনায়াসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আমার সেরকমই ইচ্ছা ছিল।
রাজকুমার বলল, ‘এখানকার দেখার জায়গা মানে প্রকৃতির পাগল করা রূপ। এছাড়া তেমন কিছু দেখার নেই। কাল তো চলেই যাব, তাই আমরা আজই সব ঘুরে নেব’।
আমি বললাম- হ্যাঁ, গাড়ি যখন আছে, তখন আর সমস্যা কোথায়?
‘না হেঁটে যাব। এটাই নাকি সবচেয়ে ভাল’।
বললাম- কে বলল? এখানকার ম্যানেজার?
ফ্রেঞ্চ টোস্ট, কলা আর সরভাজা সঙ্গে গরম লেবু চা সহকারে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। সকাল ন’টাতেও ঠান্ডায় কাঁপছি। মনে হচ্ছে, গরম জলে স্নান সেরে বেরোলে বোধহয় শীতটা কিছুটা কম লাগত। কটেজ থেকে বাইরে বেরিয়ে সারি সারি আকশচুম্বী পাহাড়ের হাতছানি। আর তারই মাঝ থেকে নিচে বিস্তীর্ণ ডুয়ার্স আর তিস্তাকে উপলব্ধি করতে চাইলাম অন্য রূপে। ‘ইচ্ছা করলে ‘গীত ঝোড়া’ যাওয়া যায়, যাবেন নাকি?’ রাজকুমারের কথায় হেসে সম্মতি জানিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে আমরা হাঁটতে শুরু করে দ্রুত নিচে নামতে লাগলাম। অনেকটা নামার পর দেখলাম, আমরা একা নয়। অনেকের মতো আমরাও নদীর ঠান্ডা জলে পা ডোবালাম। প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেল। এক ভদ্রলোক বললেন, ‘অনেকটা রাস্তা, কম করে ৪-৫ কিলোমিটার তো হবেই’। ফিরে এলাম কটেজে।
আপনি চাইলে এখান থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে সাম্বিয়ং অর্গানিক চা বাগান এবং তাদের চা তৈরি প্রণালী দেখে আসতে পারেন। যেতে পারেন লাভা, লোলেগাঁও। এছাড়া একটা ঝর্ণা ও মনেস্ট্রি ঘুরে দেখে নিতে পারেন।
দুটো দিন দারুণ সুন্দর কাটিয়ে তৃতীয় দিন সকাল ৯টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা শিলিগুড়ি যাব। রাজকুমারের বাড়ি। ঝান্ডি থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে। ওখানে একটা দিন থেকে পরদিন রাতে কলকাতায় ফেরার ট্রেনে উঠব। ঝান্ডি থেকে ফিরতে মন চাইছিল না। জীবনটা এত ছোট কেন ভেবে বড় আক্ষেপের পাশাপাশি মনে হচ্ছিল, সময়ই বা কেন মুহূর্তের জন্য থেমে থাকতে পারে না!
কীভাবে যাবেনঃ
শিয়ালদা থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে সরাসরি নিউ মাল জংশন স্টেশনে নামুন। ওখান থেকে গাড়ি বুক করে ৩২ কিমি দূরে ঝান্ডিতে চলে আসুন। মনে রাখবেন সরাসরি মাল জংশনে একমাত্র কাঞ্চনকন্যা ছাড়া অন্য কোনও ট্রেন আসে না। এছাড়া, নিউ জলপাইগুড়ি থেকেও আসা যায়। দূরত্ব ৮৭ কিলোমিটার।
কোথায় থাকবেনঃ
ঝান্ডি ইকো হাট বা হাউস ছাড়া বেশ কিছু ভাল মানের কটেজ আছে। এছাড়া পাবেন হোমস্টে। ডাবল বেডেড রুমের ভাড়া ১৫০০ টাকা থেকে শুরু। হোমস্টে ১০০০ টাকায় পেয়ে যাবেন। খাওয়া খরচ মাথাপিছু প্রতিদিন ৫০০ টাকা।
খাওয়া দাওয়াঃ
সবরকম খাবার পাবেন। বাঙ্গালীরা শুক্তো, ঘন্ট, মাঝের ঝোল, কালিয়া যাঁদের পছন্দ, তাঁরা নিরাশ হবেন না। তাই ব্রেকফাস্টে চিকেন বা ভেজ স্যানডুইচ যেমন পাবেন, তেমনই পাবেন লুচি, সঙ্গে কালোজিরে দিয়ে সাদা আলুর তরকারি। আবার চাইনিজ, মোগলাইও আছে। এমনকি, কন্টিনেন্টালও পেয়ে যাবেন। খাওয়া দাওয়া নিয়ে ঝান্ডিতে কোনও চাপ নেই।
যোগাযোগঃ ৯৪৩৪৩২৮৮৮৩/৮১৭২০৯৫০৬৩